রামায়ণ এক্সপ্রেস বিতর্ক

ভারতে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে মোদি সরকারের ‘শ্রী রামায়ণ এক্সপ্রেস’। ১৪ নভেম্বর দিল্লির সফদারজং স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করবে এই ট্রেন। ভারতীয় রেলের এই বিশেষ ট্রেনযোগে মহাকাব্য রামায়ণে বর্ণিত স্থানগুলো পরিদর্শনের সুযোগ থাকবে। তবে রেল যেহেতু শ্রীলঙ্কায় পৌঁছতে পারবে না, তাই দ্বিতীয় পর্যায়ে থাকছে বিমানযোগে শ্রীলঙ্কা পৌঁছানোর ব্যবস্থা।

nonameএই ধর্মীয় ট্যুরিজম প্যাকেজের আওতায় উত্তরপ্রদেশের অযোধ্য থেকে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো পর্যন্ত যেতে পারবেন যাত্রীরা। তাদের জন্য রামায়ণে বর্ণিত স্থানগুলো পরিদর্শন ছাড়াও থাকছে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। বিজেপি সমর্থকরা বলছেন, ভারতের ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের জন্য এটা মোদি সরকারের বড় উপহার। তবে বিরোধীরা বলছেন, রামায়ণ এক্সপ্রেসের মাধ্যমে হিন্দুদের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিতব্য ভোটের বৈতরণী পার হতে চাইছে মোদি’র দল বিজেপি।

শ্রী রামায়ণ এক্সপ্রেসে জনপ্রতি ভাড়া ১৫ হাজার ১২০ রুপি। এতে করে ১৬ দিনে রামায়ণে বর্ণিত সবকটি স্থান পরিদর্শন করতে পারবেন যাত্রীরা। বিশেষ করে হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবগুলোতে কদর বাড়বে এ ট্রেনের।

কী কী সুবিধা থাকছে?

ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্যাকেজের আওতায় ট্রেনেই খাবার দেওয়া হবে যাত্রীদের। স্টেশন থেকে স্থলপথে যাত্রীদের মন্দিরে পৌঁছাতে সহযোগিতা করবে রেল কর্তৃপক্ষ। ধর্মশালায় থাকার ব্যবস্থা থাকবে। যাত্রীদের তীর্থস্থানগুলোর মাহাত্ম্য বোঝাবেন কর্মকর্তারা। শ্রীলঙ্কায় যেতে আগ্রহীদের চেন্নাই বিমানবন্দরে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে।

মাসে কয় দফা যাতায়াত করবে এই ট্রেন; তা এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি। যাত্রীদের কাছ কেমন সাড়া মেলে, তা দেখার পরই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে রেল কর্তৃপক্ষ।

ভারত থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত রামতীর্থ দর্শন

সফর শুরু হবে দিল্লির সফদারজং স্টেশন থেকে। প্রথম স্টপ, উত্তর প্রদেশে রামের জন্মস্থান অযোধ্যায়। তারপর হনুমানগড়ি, রামকোট, কনক ভবন মন্দির ছুঁয়ে ট্রেন যাবে তপস্যাস্থল নন্দীগ্রামে। বর্তমান ফৈজাবাদের কাছে অবস্থিত নন্দীগ্রামেই বনবাস থেকে রামের ফেরা পর্যন্ত তপস্যা করেছিলেন ভরত।

কথিত আছে, এখানেই সীতাকে খুঁজে পেয়েছিলেন রাজা জনক। তারপর জনকরাজার রাজধানী জনকপুর হয়ে ট্রেন ফের যাবে উত্তর প্রদেশের বারাণসীতে। সেখান থেকে প্রয়াগ হয়ে ট্রেন পৌঁছাবে শৃঙ্গারপুর, যেখানে নিষাদ রাজের নৌকায় সীতা এবং লক্ষ্মণকে নিয়ে গঙ্গা পেরিয়েছিলেন রাম। এরপরের গন্তব্য মধ্যপ্রদেশের চিত্রকুট এবং নাসিক। বনবাসের বেশকিছু বছর নাকি এখানে কাটিয়েছিলেন রাম-সীতা।

কর্নাটকের হাম্পি

নন্দীগ্রাম থেকে কর্নাটকের হাম্পিতে ঢুকবে ট্রেন। বনবাসের শেষের দিকে দাক্ষিণাত্যের এই অঞ্চলেই ছিলেন রাম, সীতা এবং লক্ষ্মণ।

রামেশ্বরে শেষ

ভারতীয় ভূখণ্ডে শ্রী রামায়ণ এক্সপ্রেসের সর্বশেষ স্টেশন তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম। কথিত আছে, সাগর পেরিয়ে লঙ্কা যাওয়ার আগে এখানেই মহাদেবের আরাধনা করেছিলেন রাম। তার হাতে তৈরি শিবলিঙ্গই দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম রামালিঙ্গম বা রামেশ্বরমলিঙ্গ নামে প্রচলিত।

সর্বশেষ গন্তব্য শ্রীলঙ্কা

যেসব তীর্থযাত্রী রামেশ্বরম থেকে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় রামায়ণের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো দেখতে ইচ্ছুক, তাদের প্রথমে ট্রেনে চেন্নাই নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে কর্তৃপক্ষ। সেখান থেকে বিমানে শ্রীলঙ্কা যাওয়া এবং ফিরে আসার সব ব্যবস্থা করা হবে।

থাকা-খাওয়া

৮০০ আসনের ট্রেনটিতে তীর্থযাত্রীদের জন্য থাকবে খাবারের ব্যবস্থা। যেসব তীর্থস্থানে ট্রেন থামবে, সবখানেই যাত্রীদের জন্য ধর্মশালায় রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা থাকছে। তাদের সহায়তার জন্য সফরসঙ্গী হিসেবে থাকবেন টুর ম্যানেজাররা। তীর্থযাত্রীদের যাতায়াত এবং মালপত্র পৌঁছে দেওয়া, দর্শনীয় স্থাগুলোতে ভ্রমণের দায়িত্বও তাদের।

nonameবিতর্ক

ট্রেনে চড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত করেন রাজ্যসভার নির্দলীয় এমপি ঋতব্রত ব্যানার্জী। রেল পরিষেবায় ঘাটতির অভিযোগে একাধিকবার সংসদে সরব হতে দেখা গেছে তাকে। মোদি সরকারের ধর্মীয় স্থান পরিদর্শন করানোর এই উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই ট্রেনে আম জনতার কোনও লাভ নেই। যেখানে ট্রেনের যাত্রী সুরক্ষা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে, সেখানে বুলেট ট্রেনের পর এমন ধর্মীয় ভাবাবেগ উস্কে দিয়ে ট্রেন চালু করা হাস্যকর। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ইতিহাসকে নির্ভর করে পর্যটনের ব্যবস্থা থাকে। একমাত্র ভারতেই পৌরাণিক চরিত্রকে আঁকড়ে ধরে রেল সার্কিট তৈরি করা হচ্ছে। এর পেছনে কারণ একটাই, যেহেতু রাম মন্দির তৈরি করে ধর্মীয় মেরুকরণ করা যাচ্ছে না, তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে রামের তাস খেলা শুরু করা হচ্ছে।’

এর পেছনে সত্যিই কি রাজনীতি লুকিয়ে আছে? সরকারের দায়বদ্ধতা নেই? তার ভাষায়, ‘‌সামনেই লোকসভা নির্বাচন। এই সরকারের ওপর সাধারণ নাগরিকের ক্ষোভ কারও অজানা নেই। তাই অনেক ভেবেচিন্তে বিজেপি নেতারা আরএসএসের যুক্তিতে রেল মন্ত্রণালয়কে ব্যবহার করে তাদের আদি ও একমাত্র তুরুপের তাস বের করেছে। সেটা হলো এই ‌শ্রী রামায়ণ এক্সপ্রেস। ‌জনগণের ট্যাক্সের টাকায় একটা নির্বাচিত সরকার তাদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণ করছে। এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক আর কীই-‌বা হতে পারে। অন্য কোনো দেশে এমনটা ভাবা যায় না।’

বিরোধীদের এসব বক্তব্যের জবাব বিজেপিও দিয়ে চলেছে। দলটির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাহুল সিনহা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ভারতে উন্নয়নে বাধা দেওয়াই বিরোধীদের কাজ। দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নিন্দায় সরব হওয়া গবেষণার বিষয় হতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম দেশে রামের নামে বহু স্থাপত্য রয়েছে। এমনকি বিমানবন্দরের নামটিও গড়ুর। তারা রামকে ধর্মের মাপকাঠিতে বেঁধে রাখেননি। অথচ, এদেশে কিছু মানুষ নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করলেও রামের নাম শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছে। এরা কি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ?‌ নাকি ধর্মের নামে ভোট বাক্সের দিকে নজর রাখছে?’

রাহুল বলেন, ‘‌‌এ নিয়ে কোনো রাজনীতি নেই। এটা সংস্কৃতির বিষয়। গেরুয়া রঙ নিয়ে বিরোধীদের বড্ড আপত্তি। দেশের জাতীয় পতাকার সবার ওপরের রঙটিই তো গেরুয়া। এই রঙ ত্যাগের প্রতীক। তাহলে কথায় কথায় গেরুয়াকরণ কেন বলা হচ্ছে?’ সূত্র: জি নিউজ, ডয়চে ভেলে।