ক্রিকেটার ও প্লেবয় থেকে এবার দেশের ‘অধিনায়ক’

ইমরান খান। পাকিস্তান ক্রিকেট অঙ্গনে এক সফলতার নাম। ১৯৯২ সালে তার অধিনায়কত্বেই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের স্বাদ পেয়েছিল পাকিস্তান। ক্রিকেট মাতিয়ে ৯০-এর দশকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্থান ঘটে ইমরানের। দুই দশক পর সেখানেও পেলেন সফলতা। এখন পর্যন্ত নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল না পাওয়া গেলেও ৯৫ শতাংশ ভোট গণনা শেষে প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী বলা যায়, ইমরানই হচ্ছেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। সফল ক্রিকেট অধিনায়ক ও প্লেবয় হিসেবে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি-অখ্যাতি ছাড়িয়ে এখন পাকিস্তানের ভাবী ‘অধিনায়ক’ তিনি।   

ইমরান খান
ইমরানের পারিবারিক নাম আহমেদ খান নিয়াজী ইমরান। ১৯৫২ সালের ৫ অক্টোবর লাহোরে অবস্থাসম্পন্ন এক পরিবারে জন্ম তার। ইমরান খানের জীবনযাপন সবসময়ই জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলেন ইমরান৷ পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ডে। অনেক বিখ্যাত নারী ও তারকার সঙ্গে ছিল প্রেমের সম্পর্ক। ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন ক্রিকেটার, সর্বকালের সেরাদের অন্যতম। তাই সাধারণ পাকিস্তানিদের তুলনায় তার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। ১৯৯২ সালে পাকিস্তানকে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতানোর পরই তারকা বনে যান ইমরান। ফাইনালে তারা সেবার হারিয়েছিল ইংল্যান্ডকে, যারা একসময় এই অঞ্চল শাসন করে গেছে। তাই জাতীয়ভাবে নায়কোচিত আসনে বসে যান এই তারকা। বিশ্বজয়ের উৎসবের মধ্যমণিই ছিলেন তখন ইমরান। সে সময় ৩৯ বছর বয়সী ইমরান কাঁধের ইনজুরিতেও ভুগছিলেন। কয়েক বছর পরই পাল্টে যান ইমরান। তার মা ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পর একটি ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য লাখ লাখ ডলার সংগ্রহ করেন। এরপর ইসলামিমনাও হতে থাকেন ধীরে ধীরে। কমতে থাকে ক্যামেরার সামনে আসা, পাদপ্রদীপের আলো থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে থাকেন। তার দাবি ছিলো, এমন জীবন কখনোই শান্তি এনে দেয়নি তাকে।

ক্রিকেটার ইমরান

ইমরানের আজকের যে যশ-খ্যাতি, তার সবচেয়ে বড় অংশ এসেছে ক্রিকেট থেকে। ১৯৬৮ সালে ষোল বছর বয়সে লাহোরের হয়ে সারগোরার বিরুদ্ধে প্রথম ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেন তিনি৷ ক্রিকেটের প্রতি ইমরান খানের আগ্রহ এবং লেগে থাকাই তাঁকে দ্রুত স্থান করে দেয় পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলে। ১৯৭০ সালে যখন দলে ডাক পান, তখনও তার পড়াশোনাই শেষ হয়নি৷। এরপর জাতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে খেলেছেন, হয়েছেন অধিনায়কও। ১৯৯২ সালে তার হাত ধরেই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের স্বাদ পায় পাকিস্তান। তিনি বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডারদের একজন। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় নিজের পছন্দের ক্রিকেটারদের নিয়ে দল গঠন করতে একেবারে একরোখা ছিলেন ইমরান। বলা হয়, এক পকেটে নিজের পছন্দের দল নিয়ে নির্বাচকদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসতেন। আর অন্য পকেটে রাখা থাকতো পদত্যাগপত্র। নির্বাচকরা তার কথায় রাজি না হলে ইস্তফা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতেন। অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করার সময় সেই ইউনিভার্সিটি টিমকেও নেতৃত্ব দেন তিনি। ক্রিকেটে পাওয়া জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েই রাজনীতিতে নামেন ইমরান। তার দলের প্রতীকও ক্রিকেট ব্যাট। দলের নাম পিটিআই হলেও জনগণ একে ক্যাপ্টেন্স বলে সম্বোধন করেন প্রায়ই।

1532589193511

প্লেবয় ইমরান

অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করা ইমরান খান ৭০ দশকের শুরু থেকে দুই দশক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অত্যন্ত জনপ্রিয় নাম ছিল। লন্ডন নাইটক্লাবের বিতর্কিত ঘটনায় তাকে প্লেবয় হিসেবেও আখ্যা দিয়েছিল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। তবে ইমরানের দাবি, তিনি কখনও মদপান করেননি।এর আগে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেক আগ্রহ ছিল বিশ্ব মিডিয়ার। ১৯৯৫ সালে বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী জেমস গোল্ডস্মিথের মেয়ে জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করন ইমরান। তখন তার বয়স ৪৩। সেই সংসারে দুই ছেলে সন্তান হয় ইমরানের। জেমিমাকে বিয়ের শুরু থেকেই বিতর্কের মুখোমুখি হন ইমরান। তার চেয়ে ২০ বছরের ছোট ইহুদি এক নারীকে বিয়ের বিষয়টি সহজভাবে নেয়নি পাকিস্তানিরা। ২০০৪ সালে বিচ্ছেদ ঘটে ইমরান ও জেমিমার।

samaaa-jemima

২০১৫ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে করেন ইমরান। এবার ঘর বাঁধেন সাংবাদিক রেহাম খানের সঙ্গে। তবে সেই বিয়ে টিকেনি এক বছরও। বিবিসির সাবেক এই সাংবাদিক অভিযোগ করেন, সমর্থকদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছিলেন তিনি। নিজের লেখা আত্মজীবনীতে ইমরানের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আনেন তিনি। পাকিস্তানে সেই জীবনী বিতর্কের ঝড় তোলে।

২০১৮ সালে আবারও বিয়ে করেন ইমরান। পাঁচ সন্তানের জননী বুশরা ওয়াতোর সঙ্গে ঘর বাঁধেন তিনি। আধ্যাত্মিক পরামর্শক হিসেবে বুশরার খ্যাতি রয়েছে। ইসলাম নিয়ে জনসমক্ষে অনেক কথা বলেন তিনি।

2E3752CA00000578-0-image-a-1_1446939776131

রাজনীতিবিদ ইমরান

১৯৯৬ সালে জাস্টিস মুভমেন্ট নামে একটি দল গঠন করেন ইমরান। অনেক দিন চেষ্টা করলেও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারেননি তিনি। পার্লামেন্টে কোনও আসন পায়নি দলটি। এমনকি একটা সময় ইমরান উপহাসের পাত্রে পরিণত হন। নওয়াজ শরিফের দল মুসলিম লিগ ও ভুট্টো পরিবারের পাকিস্তান পিপলস পার্টি তখন সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। সারাদেশ জুড়ে তখন তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। প্রথম আসন পেতে ইমরানকে অপেক্ষা করতে হয় ২০০২ সাল পর্যন্ত। নিজ দলের হয়ে ইমরানই একমাত্র আসনে জয় পান। আর ২০০৮ সালের নির্বাচনই বয়কট করেন। সারা বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের অত্যন্ত পরিচিত মুখ হলেও অনেকদিনই তিনি সাফল্য থেকে অনেক দূরে ছিলেন। ২০১৩ সালেই তিনি শক্তভাবে প্রথম নিজের অবস্থান জানান দেন। তখন দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কয়েকটি আসন দূরে ছিলেন মাত্র। আর এর পাঁচ বছর পর এবার ২০ কোটি জনসংখ্যার পরমাণু শক্তিধর এই দেশটির দায়িত্ব ন্যস্ত হতে যাচ্ছে তার কাঁধে।

পাকিস্তানে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে সরব ছিলেন ইমরান। এর প্রতিবাদে অনশন কর্মসূচি করায় জেলেও জেতে হয় তাকে। লাহোরে একটি ছাত্রদের র‍্যালিতে কট্টরপন্থীরা তাকে আটক করে পুলিশের কাছে তুলে দেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। ইমরান উদারপন্থাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও একই সময়ে ইসলামিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে চান। বরাবরই পশ্চিমাবিরোধী অবস্থানের কথাও ব্যক্ত করেছেন তিনি। বিশেষ করে পাকিস্তানে মার্কিন ড্রোন হামলার ঘোর বিরোধী তিনি। বারবারই বলেছেন, ক্ষমতায় এলে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করবেন। তালেবানের বিরোধিতা করলেও তার শাসনে থাকা খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে ‘তালেবানের জনক’ খ্যাত মাওলানা সামিউল হকের মাদ্রাসায় ৩০ লাখ ডলার অনুদান দেন তিনি।

Pakistan-parliament-elections-2018-Imran-Khan-994327

তবে ইমরান রাজনীতিবিদ হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছেন মূলত তার দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের কারণে। বারবারই তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর সেটাই দুর্নীতিতে জর্জরিত পাকিস্তানি তরুণদের পছন্দের প্রার্থীতে পরিণত করেছে। তবে মানবাধিকার কর্মী ও ইমরান খানের প্রতিদ্বন্দ্বীদের দাবি, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপ রয়েছে। প্রভাব রয়েছে সংবাদমাধ্যমের ওপরও। কিছুদিন আগেই তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এক বছর আগেই তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। ধারণা করা হয়, এসব কিছুই আসলে সামরিক চাপেই হয়েছে। নওয়াজ শরিফের দলের অনেক নেতাই এই রোষানলে পড়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী নওয়াজের দলকে নেতৃত্বহীন করে ইমরানকে ক্ষমতায় আনতে চেয়েছে। সূত্র: বিবিসি, ডয়চে ভেলে, দ্য গার্ডিয়ান