বিশ্বনন্দিত আলোকচিত্রী ও অ্যাকটিভিস্ট শহিদুল আলমকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্বের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, শিল্পী, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা। সাংবাদিকতার সুরক্ষা, মানবাধিকার ও আলোকচিত্র সংশ্লিষ্ট বেশকিছু সংগঠনের পক্ষ থেকেও তাকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। ফ্রি শহিদুল আলম হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার মুক্তির দাবি তুলেছেন অনলাইন সমর্থকরা। নেদারল্যান্দভিত্তিক সংস্থা ‘প্রিন্স কজ ফান্ড’ আটক শহিদুল আলমের মুক্তির দাবি-সম্বলিত ২টি পিটিশনে স্বাক্ষর করার আহ্বান জানিয়েছে সবাইকে। প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের সম্পাদকীয় ভাষ্যেও তার মুক্তির দাবি তোলা হয়েছে।
সংস্কৃতি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ‘প্রিন্স কজ ফান্ড’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯৬ সালে। সংস্থাটির সদর দফতর নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে অবস্থিত। প্রিন্স কজ ফান্ডের সহযোগী সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ভিয়েতনাম, ইউক্রেন, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাজ্য, কঙ্গো, কম্বোডিয়া, কেনিয়া, নেপাল, সেনেগাল, সিরিয়াসহ আরও অনেক দেশের সংগঠন। শহিদুল আলমের পরিচালিত দৃক গ্যালারিও এসব সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। ‘প্রিন্স কজ ফান্ড’ মূলত লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ও পূর্ব ইউরোপে কাজ করে। সংস্থাটি নেদারল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তাপ্রাপ্ত। দৃক গ্যালারি, ছবি মেলা ও পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা এই অধিকার কর্মীকে সংস্থাটির ঘনিষ্ঠ বন্ধু আখ্যায়িত করে ‘প্রিন্স কজ ফান্ডের’ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শহিদুল আলম বহুদিন ধরেই তাদের জন্য প্রেরণার উৎস। শহিদুল ও প্রিন্স কজ ফান্ড একই মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন: বিশ্বের সব মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান ৮ আগস্ট শহিদুল আলমকে নিয়ে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের উচিত তাকে মুক্তি দেওয়া শিরোনামের ওই সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, কঠোর একটি আইনে যাদেরকে টার্গেট করা হয়েছে তাদের একজন হলেন বিখ্যাত এই আলোকচিত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট। তাকে মুক্তি দেওয়া এবং আইনটি পরিবর্তন করা উচিত। সম্পাদকীয়তে দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের উচিত আইনটির যথোপযুক্ত সংস্কার করার জন্য বাংলাদেশকে চাপ দেওয়া এবং শহিদুল আলমকে মুক্তি দেওয়া, তার বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগ প্রত্যাহার এবং পুলিশি হেফাজতে তাকে নির্যাতনের ঘটনা তদন্তের জন্য আহ্বান জানানো। ফটোগ্রাফিতে শহিদুল আলমের অবদানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ওই সম্পাদকীয় ভাষ্যে বলা হয়, এমন একজন হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিত্ত্বকে গ্রেফতারের কারণে নিশ্চিতভাবে ব্যক্তির বৈধ মত চর্চার অধিকার খর্ব করতে আইনের প্রয়োগ করা হয়েছে। ওই সম্পাদকীয়তে শহিদুল আলমের সুরক্ষার প্রশ্নকে বাংলাদেশে সাংবাদিক ও জনগণের মত প্রকাশের অধিকার রক্ষার প্রশ্ন আখ্যা দেওয়া হয়।
শহিদুল আলমকে তুলে নিয়ে যাওয়া ও তার গ্রেফতারির ঘটনায় গভীর বিস্ময় ও হতাশা প্রকাশ করেছে পাঁচশতাধিক প্রকাশকের সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাবলিশার্স’ (আইএআইপি)। শহিদুল আলম আইএআইপির সহযোগী হওয়ায় তার সঙ্গে বহুবার যোগাযোগ হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছে সংগঠনটি। তাদের ভাষ্য, ‘আমরা মনে করি, শহিদুলকে ভীত করে দিতে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা অনুযায়ী যেভাবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তাতে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাকে যথযথ প্রক্রিয়া ব্যতিরেকে আটক করা হয়েছে এবং আমরা জানতে পেরেছি, আটক অবস্থায় তার ওপর নৃশংস অত্যাচার করা হয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সেই অধিকারকে রক্ষা করতে চাওয়া গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের মূল বিষয়গুলোর একটি। আইএআইপি শহিদুল আলমের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করছে।’
ভারতের ‘কোচি বিয়েন্নালে ফাউন্ডেশন’ শহিদুলের গ্রেফতারের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘শহিদুলের তোলা বেদনাজাগানিয়া ক্রসফায়ারের ছবিগুলো কোচি-মুজিরিস বিয়েন্নালেতে ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে যে ধরণের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন হয়েছে, বিশেষ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, তার নিন্দা জানাচ্ছে আমাদের ফাউন্ডেশন।’ সংস্থাটি শিল্পপ্রেমীদের শহিদুল আলমের মুক্তির দাবিতে তৈরি করা অনলাইন আবেদনে স্বাক্ষরের আহ্বান জানিয়েছে।
সমর্থকরা অনলাইনে ফ্রিশহিদুলআলম হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে শহিদুলসহ গ্রেফতারকৃত অন্যান্যদের মুক্তির দাবি করছেন। পুলিৎজার সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক জন সয়ার বলেছেন, ‘সমালোচকদের চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করে বাংলাদেশ সরকারের উচিত নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও গ্রেফতার হওয়ার হুমকি ব্যতিরেকেই সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালন করতে পারার মতো পরিবেশ নিশ্চিত করা।’ ভারতীয় সাংবাদিকরা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে বুধবার মৌন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন বাংলাদেশি সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও ফটোগ্রাফার শহিদুল আলমকে গ্রেফতার করার ঘটনার প্রতিবাদে। ২৫০ জন ফটোগ্রাফার, শিল্পী, সাংবাদিক ও অধিকার কর্মীর লেখা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘শহিদুল আলমকে গ্রেফতার করা ও তার ওপর চালানো নির্ম নিপীড়নের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি আমরা। শহিদুল তার নাগরিক অধিকারের অনুযায়ী কাজ করেছেন। নিপীড়নমূলক তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়াটা অগ্রহণযোগ্য।’ স্বাক্ষর দাতাদের মধ্যে রয়েছেন রাম রহমান, ভিভান সুন্দারাম, পার্থিব শাহ, পুষ্পমালা এন, রঘু রাই, এবং দেভিকা দৌলাত সিং প্রমুখ।
মঙ্গলবার (০৭ আগস্ট) চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিল্পীদের দেওয়া অপর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আইসিটি আইনের অধীনে আমাদের সহকর্মী, বন্ধু ও পরামর্শক, চিত্রশিল্পী ও শিক্ষক শহিদুল আলমকে ঢাকায় অযৌক্তিকভাবে ও বিনা কারণে আটকের খবরে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ। শহিদুল আলম তাই করেছেন, যা প্রতিটি বিবেকবান নাগরিকের করা উচিত। নিজের ক্যামেরা আর কণ্ঠকে অস্ত্র বানিয়ে তিনি সেই পরিস্থিতির দিকে নজর ফিরিয়েছেন যাতে জরুরি মনোযোগের প্রয়োজন ছিল। আমরা অবিচলভাবে তার সঙ্গে আছি।