মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে চান রাশিয়ায় বন্দি চলচ্চিত্র নির্মাতা

৯০ দিন ধরে কিছু খাননি ইউক্রেনের চলচ্চিত্র নির্মাতা ওলেগ সেন্তসোভ। রাশিয়ার একটি কারাগারে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে আটক থাকা সেন্তসোভ অনশন করছেন। রাশিয়ায় বন্দি থাকা প্রায় ৭০ জন ক্রিমিয় রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি চান তিনি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ক্রিমিয়া দখলের অভিযোগ করে আসছেন তিনি। আর দাবি না মানলে মৃত্যু পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। 

ইউক্রেনের চলচ্চিত্র নির্মাতা ওলেগ সেন্তসোভ

২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল করার সময় ৪২ বছর বয়সী সেন্তসোভকে গ্রেফতার করা হয়। সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তার বিচার প্রক্রিয়াকে ‘স্ট্যালিনবাদ’ বলে অভিহিত করেছে। তারপর সেন্তসোভকে রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলের দুর্গম উত্তর মেরু এলাকার কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত জেলখানায় রাখা হয়েছে।

রাশিয়ায় কারাগারে বর্তমানে বন্দি থাকা প্রায় ৭০ জন রাজনৈতিক বন্দির মুক্তির দাবিতে গত ১৪ মে তারিখে সেন্তসোভ অনশনের ঘোষণা দেন। তারপর থেকেই তিনি খাবার খাচ্ছেন না। শুধুমাত্র গ্লুকোজ ও ভিটামিনের পরিপূরক উপাদান তার শরীরে ঢোকানো হচ্ছে। মঙ্গলবার তার আইনজীবী দিমিত্রি ডিনজে তাকে দেখে আসার পর জানান, তার ওজন প্রায় ৬৬ পাউন্ড কমে গেছে। তার হৃদস্পন্দন করে প্রতি মিনিটে ৪০ এ নেমে এসেছে।

সেন্তসোভের চাচাতো বোন নাতালিয়া কাপলান বৃহস্পতিবার তার কাছ থেকে একটি চিঠি পাওয়ার কথা জানান। চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন যে, তিনি এখন দাঁড়াতে পারেন না। তিনি লিখেছেন, ‘শেষ সময় কাছে চলে এসেছে’। নাতালিয়া এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘পরিস্থিতি এখন খারাপ নয়, বিপর্যয়করভাবে খারাপ।’  

ইউক্রেনের মানবাধিকার কর্মী লিয়ুদমিলা ডেনিসোভা বৃহস্পতিবার সেন্তসোভের একটি ছবি প্রকাশ করেছেন। রাশিয়ার এক সহকর্মীর কাছ থেকে ছবিটি পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন তিনি। ছবিতে সেন্তসোভকে রোগাটে ও দুর্বল মনে হয়েছে। গ্রেফতারের সময় তার ওজন ২২০ পাউন্ড থাকলেও তা কমে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে রাশিয়ার কারা কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার বলেছে, সেন্তসোভে পরিস্থিতি সন্তোষজনক ছিল।

সেন্তসোভের আইনজীবী কর্তৃপক্ষের এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বলে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি’কে জানিয়েছেন। তার দাবি, সেন্তসোভের অবস্থা খুবই খারাপ। তিনি বলেন, সেন্তসোভ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ‘হ্যা, তিনি মৃত্যু পর্যন্ত নিজের অবস্থান থেকে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত।’

চার বছর আগে যখন রাশিয়া ক্রিমিয়ায় আক্রমণ চালায় তখন সেন্তসোভ একজন সফল চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন। ২০১১ সালে তার সেরা ছবি ছিল ‘গামের’। আন্দোলনকর্মী সংগঠনের সদস্য হিসেবে তিনি রুশ আগ্রাসনের প্রতিবাদ করেন। তিনি রুশ বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেন ও রুশ সেনাদের হাতে ফাঁদে আটকে পড়া অবস্থায় ইউক্রেনের সেনাদের খাবার সরবরাহ করেন। দখলের দুই সপ্তাহ পরই সেন্তসোভকে আটক করে রাশিয়া। সেন্তসোভের দাবি, তাকে নির্যাতন করা হয়েছে, প্লাস্টিকের ব্যাগের মাধ্যমে দম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ও ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে।

ফেসবুকে প্রকাশিত ওলেগ সেন্তসোভের ছবি

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সেন্তসোভের বিচার প্রক্রিয়াকে ‘স্ট্যালিনবাদী লোক দেখানো বিচার’ বলে অভিহিত করেছে। তার বিরুদ্ধে বানোয়াট অভিযোগ ও নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। একটি সামরিক আদালতে তার বিরুদ্ধে ক্রিমিয়ার একটি রুশপন্থী রাজনৈতিক দলের দরজায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া ও লেলিনের একটি মূর্তি ভেঙে ফেলার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। তবে রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। এমনকি একজন প্রধান সাক্ষীও নিজের স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করে। ওই সময় সাক্ষী দাবি করেছিলেন, নির্যাতনের মুখে তিনি ওই সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তারপরও আদালত সেন্তসোভকে দোষী সাব্যস্ত করে।  

ক্রিমিয়া স্ত্রীসহ দুই ছোট বাচ্চা থাকলেও সেন্তসোভকে প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার দূরের কারাগারে রাখা হয়েছে। উত্তর মেরু অঞ্চলের ওই কারাগারে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা থাকে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের শীর্ষ গবেষক তানিয়া লোকশিনা বলেন, ‘তারা সেন্তসোভকে একটি উদাহরণ বানাতে চায়। তাকে এমন অপরাধের জন্য ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে যা তিনি করেননি।’

সেন্তসোভের মামলাটি আন্তর্জাতিক মনযোগও আকর্ষণ করতে পেরেছে। জনি ডেপ, ঔপন্যাসিক স্টিফেন কিং ও পরিচালক পেদ্রো আলমোদোভারসহ অনেক রাজনীতিক ও চলচ্চিত্র তারকা তার মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। তবে রাশিয়া এসব আহ্বানে খুব একটা কর্ণপাত করছে না।

ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত সেন্তসোভকে ক্রিমিয়ার কাছের একটি সরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করতে রাশিয়াকে নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া যথাযথ চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি অনশন ভাঙতে আহ্বান জানানোর নির্দেশ দেয় আদালত। তবে সেন্তসোভ সেখান থেকে কোথাও যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তিনি বলেছেন, তার এখন এত ভ্রমণ করার ক্ষমতা নেই। আইনজীবীর মাধ্যমে ফেসবুকে প্রকাশিত এক চিঠিতে তিনি বলেছেন, ‘আমি অসুস্থ নই। আমি অনশন করছি। আর আমি থামার কোনও পরিকল্পনা করিনি’।