নিউ জিল্যান্ডের হামলায় নিহত ৪৯ জনের অনেকেই শরণার্থী হিসেবে দেশটিতে গিয়েছিলেন। নিজ দেশে হওয়া সহিংসতা থেকে বাঁচতে সেখানে আশ্রয় নিয়েও, সহিংস ঘটনাতেই প্রাণ দিতে হয়েছে তাদের। নিহতদের মধ্যে আছেন যেমন আছেন হামলাকারীকে বাধা দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়া শিক্ষক, তেমন আছেন গুলি থেকে অন্যদের রক্ষার জন্য বুক পেতে দেওয়া অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী। প্রাণ গেছে ৩ বছর বয়সী শিশু থেকে শুরু করে স্বামীকে বাঁচাতে ছুটে যাওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারীর। নিউ জিল্যান্ডের সরকার এখন পর্যন্ত ক্রাইস্টচার্চ এলাকায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ভুক্তভোগীদের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংশ্লিষ্টদের মৃত্যুর তথ্য ও পরিচয় বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। সংবাদমাধ্যম বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে এমন কয়েকজনের তথ্য তুলে ধরেছে।
দাউদ নবী: ক্রাইস্টচার্চ হামলায় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের একজন দাউদ নবী (৭১)। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে তাকেই প্রথম সনাক্ত করা গেছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য থেকে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, দাউদ নবী মসজিদের মধ্যে হত্যাকারীর সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন গুলি থেকে অন্যদের বাঁচাতে। তার ছেলে ওমর বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনি হোক, ইরাকি হোক আর সিরীয়, আমার বাবাই প্রথম তাদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতেন।’
১৯৮০-এর দশকে রাশিয়া আফগানিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তিনি সপরিবারে নিউ জিল্যান্ড চলে গিয়েছিলেন। পেশায় প্রকৌশলী এই আফগানের শখ ছিল পুরাতন গাড়ি সংগ্রহ করা। অবসরের পর হয়ে ওঠেন একজন কমিউনিটি লিডার। তিনি ছিলেন স্থানীয় ‘আফগান অ্যাসোসিয়েশনের’ সভাপতি। অন্যান্য অভিবাসী সংগঠনগুলোকেও তিনি সহায়তা করতেন।
তালহা: নাঈমের সঙ্গে মারা গেছে তার ছেলে তালহা। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র তার ‘নিখোঁজ’ থাকার কথা জানালেও, পরিবারের সদস্যরা তালহার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। তালহার বন্ধুদের কাছে থেকে জানা গেছে, খুব সম্প্রতি তিনি চাকরি পেয়েছিলেন। বিয়ের পরিকল্পনাও ছিল তার। মসজিদের হামলায় আহত হয়েছে নাঈম রশিদের আরেক ছেলে। তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
সাইয়েদ মিলনে: ১৪ বছরের কিশোর সাইয়েদ মসজিদে গিয়েছিল তার মায়ের সঙ্গে। তার বাবা বলেছেন, ‘আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কিছু জানানো হয়নি। কিন্তু আমি জানি সে আর নেই। তাকে ঘটনাস্থলে দেখা গেছে।’ সাইয়েদ ফুটবল খেলোয়াড় হতে চেয়েছিল। তার এই অকাল মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত বাবা স্মরণ করেছেন, ‘জন্মের সময় আমরা প্রায় তাকে হারাতে বসেছিলাম। কিন্তু সে লড়াকু ছিল ওই সময়েই। এখন এটা মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর যে এক বেপরোয়া বন্দুকধারীর গুলিতে তাকে প্রাণ হারাতে হয়েছে।’
মুকাদ ইব্রাহিম: তিন বছর বয়সী মুকাদ ইব্রাহিমকে ১৫ মার্চের পর থেকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা হচ্ছে সেসব হাসপাতালেও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মুকাদের ভাই আবদি ইব্রাহিমের ধারণা তার ছোট্ট ভাইটা আর নেই। পুলিশ একটি শিশুর মৃত্যু হওয়ার কথা স্বীকার করেছে এবং জানিয়েছে আরও অনেকে চিকিৎসাধীন।
আমজাদ হামিদ: ৫৭ বছর বয়সী আমজাদ হামিদ পেশায় একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। হামলার ঘটনার পর থেকে এই ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ব্যক্তির তার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নেওয়ার পরও তার কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তারা মনে করছেন, তিনিও নিহত হয়েছেন। নিউ জিল্যান্ড হেরাল্ডকে তার স্ত্রী বলেছেন, ‘তিনি একজন খুবই হৃদয়বান মানুষ ছিলেন। আমরা আমাদের ও সন্তানদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিতের পরিকল্পনা করছিলাম।’
এই দম্পতি ২৩ বছর আগে নিউ জিল্যান্ডে থিতু হন। তাদের দুই সন্তান। তাদের একজন হুসাম হামিদের ভাষ্য, ‘এটা একটা নিরাপদ দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু নিউ জিল্যান্ড যেন চিরকালের জন্য পাল্টে যাচ্ছে।’
হুসেইন আল উমারি: প্রতি শুক্রবার ৩৫ বছর বয়সী হুসেইন আল উমারি মসজিদটিতে নামাজ পড়তে যেতেন। তারপর সেখান থেকে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। তিনি গত বৃহস্পতিবার তার বাবা-মায়ের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলেছিলেন। তার বাবা-মা জান্না ইজাত এবং হাজিম আল উমারি ১৯৯০-এর দশকে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে নিউ জিল্যান্ডে স্থায়ী হয়েছিলেন।
লিলিক আব্দুল হামিদ: ক্রাইস্টচার্চের ঘটনায় প্রথম যে ইন্দোনেশীয় নাগরিকের মৃত্যুর তথ্য জানা গেছে, তার নাম লিলিক আব্দুল হামিদ। হামলার শিকার দুই মসজিদে ইন্দোনেশিয়ার সাত ব্যক্তি ছিলেন। এদের মধ্যে পাঁচ জন ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসে নিজেদের তথ্য জানিয়েছেন।
সোমালিয়ার অন্তত চারজন দুই মসজিদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। হামলার শিকার আল নূর মসজিদটির পরিচালনায় সোমালিরা যুক্ত। এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে যাদেরকে ‘নিখোঁজের’ তালিকায় রাখা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, জর্ডান, আফগানিস্তান, ফিজি এবং সৌদি আরবের বংশোদ্ভূত ব্যক্তিরা।