কৃষিভিত্তিক নববর্ষ উদযাপন করে তিব্বতীয়রাও

বাঙালি নববর্ষের সাংস্কৃতিক ভিত্তি যেমন কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের গভীরে, একই বাস্তবতা তিব্বতীয়দেরও। বছরে তারা ৪ বার নববর্ষ উদযাপন করলেও সবথেকে গুরুত্ব দিয়ে উদযাপন করে জিউতসাং উৎসব, যা তাদের কৃষি নববর্ষ হিসেবে বিবেচিত হয়। নতুন দিনের জন্য ভালো ফসলের প্রার্থনা, সমগ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কল্যাণ আর মঙ্গল কামনার পাশাপাশি জিউতসাং উৎসব তিব্বতীয় নারীদের জন্য স্বীকৃতিরও দিন। কৃষিজীবী পরিবারে সারা বছর নারীকে ফসল উৎপাদন আর বীজ সংরক্ষণে  সংলগ্ন থাকতে হয় বলে নববর্ষের দিনটিতে তাদের পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের উপহারও দেয় পুরুষরা।  

কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে  নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালির বর্ষবরণের সাংস্কৃতিক ভিত্তি। কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার শুরু মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন। বাংলা সন কার্যকর হওয়ার শুরুর দিকে তা ফসলি সন নামেই পরিচিত ছিল, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। একইভাবে কৃষিকে অগ্রভাগে রেখে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির প্রথম মাসের শুরুতে জিউতসাং নববর্ষ উদযাপন করে তিব্বতীয়রা। ফসল কেটে গোলায় তোলার মধ্য দিয়ে গোটা বছরের কঠোর পরিশ্রমের অবসান ঘটে তখন। কৃষিভিত্তিক পরিবারগুলো তাদের আনন্দের মুহূর্তগুলো ভাগাভাগি করে নেয় তখন। উদযাপনের ভিত্তিও হয় কৃষি কর্মকাণ্ড। 

তিব্বতীয়দের কৃষক নববর্ষে থাকে নারীর প্রাধান্য। সারা বছরের পরিশ্রম শেষে নববর্ষের দিনটি তাদের বিশ্রামের দিন। এদিন বাড়ির সব কাজ পুরুষরাই করে থাকেন। নারীরা ব্যস্ত থাকেন সাজসজ্জায় আর গল্প-আনন্দে। দিনটি পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কাছ থেকে নারীদের উপহার পাওয়ারও দিন।  নববর্ষের দিনটি শুরু হয় ভালো ফসলের প্রার্থনা দিয়ে। শুরু হওয়া নতুন বছরে মানুষের জীবন ও সম্পদের সুরক্ষার জন্যও প্রার্থনা করা হয়। ফসলের প্রাচুর্য, সুরক্ষা আর সুখসমৃদ্ধির আশায় সকাল বেলায় বাড়ির ছাদে প্রজ্বলিত হয় অগ্নিশিখা।

জিউতসাং-এর প্রথম দিনটিতে বাড়ির উঠোন পরিষ্কার করে সেখানে গম-ভুট্টা-মটরশুটির মতো উচ্চভূমিতে জন্ম নেওয়া ফসল ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সে সময় বাড়ির সবথেকে উপরের তলায় অপেক্ষমান থাকে কখন পাখিরা এসে ওইসব শস্য খাবে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী মনে করা হয়, যে ফসলে পাখি মুখ দেবে, নতুন বছরে সেই শস্যের বাম্পার ফলন হবে। আর যে ফসলে পাখি মুখ দেবে না, সেটায় ভালো ফলন হবে না। আর যদি পাখি সব শস্যেই মুখ রাখে, তাহলে সেটা হবে দুর্দান্ত ফসলের বছর। তিব্বতীয়দের প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী পাখিরা স্বর্গ থেকে প্রেরিত হয়। ফসল কেমন হবে তা আগে থেকেই বুঝতে পারে তারা।

জিউতসাং নববর্ষের দ্বিতীয় দিনে কৃষির মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা-পতাকা ওড়ানো হয়। উইলো গাছের সরু কাণ্ডে চাররঙের কাপড় লাগানো হয়। পৃথক চারটি রঙে আলাদা আলাদা প্রতীকী বাস্তবতা উপস্থাপিত হয়। সবার ওপরে নীল রঙের কাপড় দিয়ে নীলাভ আকাশকে প্রতীকায়িত করা হয়। এরপর থাকে সাদা কাপড়, যা দিয়ে মেঘাচ্ছন্ন বাস্তবতা তুলে ধরা হয়। তৃতীয় অংশে থাকে লাল রঙের কাপড় যা দিয়ে আগুনকে নির্দেশ করা হয়। সবশেষে হলুদ কাপড় ব্যবহারের মধ্য দিয়ে পানিকে প্রতীকায়িত করা হয়।