ভারতের কলকাতায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙচুর করেছে দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের কেন্দ্রীয় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের এক রোড শো থেকে এই ভাঙচুর চালানো হয়। বিদ্যাসাগর কলেজে চালানো এ তাণ্ডব থেকে বাদ যায়নি কলেজের আসবাবপত্র। তাতেও ক্ষান্ত না হয়ে শেষমেষ কলেজের অফিস ঘরে বসানো বিদ্যাসাগর-মূর্তি আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে বিজেপি সমর্থকরা। আগামী সেপ্টেম্বরে বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্তি পালিত হবে। তার আগেই ১৪ মে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বর্বরোচিত এ ঘটনা ঘটলো।
মঙ্গলবার শুধু বিদ্যাসাগর কলেজেই নয়, এদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসেও তাণ্ডব চালায় মারমুখী বিজেপি সমর্থকরা। বাইরে থেকে ক্যাম্পাসে পাথর ও ইট নিক্ষেপ করে তারা। তাদের ছোড়া পাথরের আঘাতে আহত হন বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মী। এ সময় ক্যাম্পাসে থাকা বাইকেও আগুন ধরিয়ে দেয় বিজেপির নেতা-কর্মীরা।
পুরো বিদ্যাসাগর কলেজ এলাকা রণক্ষেত্রে রূপ নিলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দোকানের ঝাঁপ ফেলে পালিয়ে যান। এক পর্যায়ে বিশাল পুলিশ বাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে দেখা যায়, কলেজ-চত্বরে বিদ্যাসাগরের ভাঙা মূর্তি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। অফিসঘরের কাচ, দরজা, আসবাব ভাঙা। ভেতরটাও লণ্ডভণ্ড। তৃণমূল সমর্থক শিক্ষার্থী স্বর্ণালী মিশ্র বলেন, ‘‘আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। হামলাকারীদের দেখে পালিয়ে যাই।’’ গোলমালের পরে পুলিশ পোড়া মোটরবাইক সরাতে গেলে বিক্ষোভ শুরু করে তৃণমূলের ছাত্র সংগঠন।
নির্বাচনি প্রচারণার মধ্যেই মূর্তি ভাঙার খবর পান মমতা। তিনি কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে ফোন করে কঠোর নির্দেশ দেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়। বিজেপির কিছু লোক এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। যে-কোনও মূল্যে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে হবে।’’ পুলিশ রাতে জানায়, ১৬ দুষ্কৃতিকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ কমিশনার রাজেশ কুমার জানিয়েছেন, ইতোমধ্যেই তদন্ত শুরু হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং পুলিশ কমিশনারও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, আজ বুধবার তার বিক্ষোভ কর্মসূচি রয়েছে। সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিলে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। মমতা বলেন, ‘‘অনেকে বলছে, পুলিশের তরফে নাকি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে গোটা ঘটনায় তৃণমূলের ওপর দায় চাপানো হয়েছে। কিন্তু আমি পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। এমন কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি। পুরোটাই ভুয়া। তৃণমূল এসব করে না। এত বছর ধরে মিছিল করেছি। আমাদের ছাত্ররা মিছিল করেছে। কোনও দিন এমন ঘটনা ঘটেনি।’’
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে বিধান সরণি দিয়ে অমিত শাহের রোড শো চলছিল। আচমকা এক দল সমর্থক পাঁচিল টপকে বিদ্যাসাগর কলেজের বিধান সরণি ক্যাম্পাসে ঢুকে তাণ্ডব শুরু করে। একটি মোটরসাইকেল ও একটি সাইকেলে আগুন ধরানো হয়। ওই কলেজের তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি) নেতা অভিষেক মিশ্রের অভিযোগ, ‘‘আমরা কিছু করিনি। ক্যাম্পাসের ভিতরে ‘মোদি গো ব্যাক’ লেখা পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওরা দেয়াল টপকে ঢুকে ইট ছুড়তে শুরু করে।’’ অভিষেকের কান ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। বিজেপি-সমর্থকদের হাতে নিগৃহীত হন তিনি।
বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ গৌতম কুণ্ডু বলেন, ‘‘বিজেপির মিছিল থেকেই তাণ্ডব চালানো হয়েছে। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে ওরা। পুলিশে অভিযোগ দায়ের করছি।’’ কলেজ পরিচালনা কমিটির সদস্য দেবাশিস কর্মকার জানান, অফিসে রাখা তার ল্যাপটপও ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে বিজেপি-র অভিযোগ, অমিত শাহের রোড শোতে ইট ছুড়ে আক্রমণ চালিয়ে প্রথমে গোলমাল বাধিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। রোড শো শুরুর আগেই পোস্টার-ফেস্টুন খুলে ফেলে উসকানি দিয়েছে দলটি।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে গোলমাল শুরু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাস থেকে। শাহকে কালো পতাকা দেখানোর জন্য গেটের বাইরে জড়ো হয় তৃণমূল সমর্থক। গোলমাল এড়াতে বিজেপির প্রচারের ব্যানার দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করেছিল পুলিশ। অভিযোগ, ক্যাম্পাসের ভিতর থেকে মিছিল লক্ষ্য করে পানির বোতল, আইসক্রিমের কাপ ছোড়া হয়। এক পর্যায়ে বিজেপি-সমর্থকরা মারমুখী হয়ে উঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে ব্যারিকেড উল্টে দেয় তারা।
রণক্ষেত্রে রূপ নেয় গোটা এলাকা। টিএমসিপি-সমর্থকদের আড়াল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় পুলিশ। বিজেপি-সমর্থকরা গালমন্দ করতে করতে ইট ছুড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএমসিপি নেতা মণিশঙ্কর মজুমদারের দাবি, ‘‘ওরা ইট, পেরেক লাগানো লাঠি দিয়ে হামলা করেছে। আমাদের অনেকে আহত হয়েছে।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এই হামলা ও শিক্ষার্থীদের আহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে ফোন করা হলেও উপাচার্য সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায় সাড়া দেননি। উত্তর দেননি মেসেজেরও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পার্থিব বসু গোটা ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন।
অমিত শাহ এবং অন্য বিজেপি নেতা যে-গাড়িতে ছিলেন, কলেজ স্ট্রিটের গোলমালের পরেই সেটি দ্রুত এগিয়ে যায়। ঠনঠনিয়া থেকে ফের মিছিল শুরু হয় ধীর লয়ে। কিছু দূর যেতে না-যেতেই ফের শুরু হয় তাণ্ডব। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিদ্যাসাগর কলেজের বিধান সরণি ক্যাম্পাসের ভিতর থেকে মিছিলের ওপর কয়েকটি ইট উড়ে আসে। শাহকে ‘গো ব্যাক স্লোগান’ লেখা কালো পতাকা দেখানো হয়। স্লোগান চলতে থাকে। শাহের গাড়ি অবশ্য তার আগেই ওই এলাকা ছেড়ে যায়। পুলিশ পরে সেই গাড়ি মাঝপথে আটকে দিয়ে বলে, ‘‘আর এগোনোর অনুমতি নেই।’’ যদিও বিজেপির দাবি, বিবেকানন্দের জন্মভিটে পর্যন্ত রোড শো-র অনুমতি ছিল। সেই সময় অমিত শাহকে স্থানীয় বিজেপি প্রার্থী রাহুল সিংহের উদ্দেশে কড়া ভাষায় কিছু বলতে দেখা যায়। সূত্র: আনন্দবাজার, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া।