নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও অস্ত্র কিনে যাচ্ছে মিয়ানমার

ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞা এবং জাতিসংঘের সত্য অনুসন্ধান মিশনের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ছিন্নের আহ্বানের মধ্যেও অস্ত্র কিনে যাচ্ছে মিয়ানমার৷ সামরিক শক্তি বাড়াতে চীন, রাশিয়া, ভারত ও ইসরায়েল থেকে দেশটি প্রচুর প্রাণঘাতী অস্ত্র সংগ্রহ করে যাচ্ছে৷ ভৌগোলিক অবস্থান ও অস্ত্রের বাজার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছ থেকে অস্ত্র কেনায় ছাড়ও পাচ্ছে মিয়ানমার৷ ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি’র প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী
অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সামরিক-বৌদ্ধতন্ত্রের প্রচারণায় রাখাইনে ছড়ানো হয়েছে রোহিঙ্গা-বিদ্বেষ। ২০১৭ সালের আগস্টে অভিযান জোরদার করার আগের কয়েক মাসের সেনাপ্রচারণায় সেই বিদ্বেষ জোরালো হয়। এরপর শুরু হয় সেনা-নিধনযজ্ঞ। হত্যা-ধর্ষণ ও ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়ার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের মাধ্যমে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করা হয় প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে। রোহিঙ্গা নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিভাবে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে মিয়ানমার৷ দেশটির বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তবে এসব নিষেধাজ্ঞার পরও অস্ত্র কিনতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বেগ পেতে হচ্ছে না। তারা অস্ত্র কেনা অব্যাহত রেখেছে৷

অর্থনৈতিক অবরোধ শিথিল করলেও মিয়ানমারের কাছে এখনও অস্ত্র বিক্রি করছে না যুক্তরাষ্ট্র। তবে চীন অস্ত্র বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে আসছে বেইজিং৷ স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) এর তথ্য অনুযায়ী, দেশটি মিয়ানমারের অস্ত্রের প্রধান উৎস৷ প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালে মিয়ানমারের ৬৮ শতাংশ অস্ত্রের আমদানি হয়েছে চীন থেকে৷ এসআইপিআরআই-এর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ গবেষক সিমন উইজেম্যান জানান, সাঁজোয়া যান, ভূমি থেকে আকাশের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের প্রযুক্তি, রাডার ও মানববিহীন ড্রোনসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম ছিল এর মধ্যে৷

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মিয়ানমারের অন্যতম উদ্যমী বন্ধু রাশিয়া৷ গত মাসে সেদেশের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা পরিদর্শন করেছেন মিয়ানমারের সেনা প্রধান মিং অং হ্লায়াং৷

সেখানে জেনারেল হ্লায়াং একটি হেলিকপ্টার প্লান্ট পরিদর্শন করেছেন৷ এরপর ‘এমআই ১৭১’ বিমানে চড়ে গিয়েছেন সাইবেরিয়া অঞ্চলের উলান উদে শহরে৷ ওই এলাকায় তিনি বৈকাল হ্রদের ‘সৌন্দর্য্য উপভোগ' করেছেন বলে মিয়ানমারের সরকারের মুখপত্র গ্লোবাল নিউ লাইটে উল্লেখ করা হয়৷

রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শুইগু ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমার সফর করেন এবং ৬টি এসইউ-৩০ বিমান বিক্রি নিয়ে একটি চুক্তিতে সই করেন৷ এই চুক্তিটি ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বলে অনুমান করা হয়৷ ‘ফাইটার জেট’ বিমান বাহিনীর প্রধান যুদ্ধবিমানে পরিণত হয়েছে বলে সেই সময় জানান মিয়ানমারের উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী৷

ওই চুক্তির পর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বলেছিল, এই চুক্তি রোহিঙ্গা সংকটকে তীব্রতর করবে৷ তবে এই ‘অভিযোগের বিষয়ে কোনো মনোযোগ' তাদের নেই বলে তখন মন্তব্য করেছিলেন রাশিয়া সরকারের একজন মুখপাত্র৷

আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে চীনের বিপরীতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বাড়ায় ভারত৷ একইসঙ্গে রোহিঙ্গা সংকটেও নির্লিপ্ত ভূমিকা রাখে দেশটি৷ নিরাপত্তা বিশ্লেষক অ্যান্থনি ডেভিসের মতে, মিয়ানমারের নৌবাহিনীর দিকে নজর দিচ্ছে ভারত৷ মিয়ানমারকে বিশেষায়িত যন্ত্রপাতি সরবরাহের পাশাপাশি যৌথ মহড়ার প্রস্তাব দিয়ে আসছে দেশটি৷ ‘ভারতীয়রা মূলত মিয়ানমারের বিমান বাহিনীর আধুনিক করা নিয়ে কাজ করছে এবং এক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে’। বলেন ডেভিড৷

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকবার ভারত সফরে গেছেন মিয়ানমারের সেনা প্রধান মিং অং লাইং৷ ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন জোরালো হওয়ার মধ্যেও মিয়ানমারের বেসামরিক নেত্রী অং সান সুচির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ সেই সময় প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বাড়ানোর বিষয়ে সম্মত হন তারা৷

মিয়ানমারের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের৷ ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যেও মিয়ানমার সরকারকে পানি বিশুদ্ধকরণ সিস্টেম প্রদান করে ইসরায়েল৷

এর আগে ২০১৫ সালে ইসরায়েল সফর করেন জেনারেল মিং অং হ্লায়াং৷ সেই সময় হলোকস্ট জাদুঘরের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সরবরাহ ব্যবস্থাও পরিদর্শন করেন তিনি৷ ২০১৭ সালের এপ্রিলে মিয়ানমারের নৌবাহিনী তাদের ফেসবুক পাতায় ইসরায়েল নির্মিত ‘সুপার ডিভোরা এমকে-৩’ পেট্রোল বোটের বেশ কিছু ছবি পোস্ট করেছিল৷

একটি ছবির ক্যাপশনে লেখা ছিল: ‘মিয়ানমারের জলসীমায় সে ৪৫ নটিক্যাল মাইল গতিতে চলছে৷ মিয়ানমারের নৌবাহিনীতে স্বাগতম!’

তবে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ইসরায়েলের অভ্যন্তরেই নানা ধরনের বিতর্ক রয়েছে৷ তাই ২০১৭ সালে একবার অস্ত্র বিক্রি বন্ধও হয়ে গিয়েছিল। ইয়াঙ্গুনের ইসরায়েল দূতাবাস জানিয়েছে, ‘মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র না করার সিদ্ধান্তে বদল ঘটেনি’৷