আবারও পরমাণু চুক্তির প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসছে ইরান

ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা ৫% শতাংশে উত্তীর্ণ করার ঘোষণা দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো পরমাণু চুক্তির প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসলো ইরান। ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে এই মাত্রা ৩.৬৭% শতাংশে সীমিত রাখার প্রতিশ্রুতি ছিল তেহরানের। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি চুক্তির প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ইউরোপকে ৬০ দিনের বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হওয়ার পর এই ঘোষণা এলো। চুক্তি রক্ষায় তেহরানের অঙ্গীকারের কথা জানিয়ে ইরানি উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকশি অভিযোগ করেছেন, ইউরোপ তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থেকে ইরানকে রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে প্রতি ৬০ দিন পর পর নিজেদের প্রতিশ্রুতি থেকে একটু একটু করে সরে আসার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চলমান তীব্র উত্তেজনার মধ্যে এমন ঘোষণা এলো। 

গত মাসে একটি পারমাণবিক প্রযুক্তি কেন্দ্র পরিদর্শন করেন রুহানি
২০১৫ সালের জুনে ভিয়েনায় ইরানের সঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের ৫ সদস্য রাষ্ট্র—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানির স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করার প্রতিশ্রুতি দেয় তেহরান। পূর্বসূরি ওবামা আমলে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিকে ‘ক্ষয়িষ্ণু ও পচনশীল’ আখ্যা দিয়ে গত বছরের মে মাসে তা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৮ সালের নভেম্বরে তেহরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল হয়। এদিকে ইউরোপীয় দেশগুলো এ সমঝোতা বাস্তবায়নের কথা মুখে বললেও কার্যত তারা কোনও পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ করে আসছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া এবং নিজেদের প্রতিশ্রুতি পালনে ইউরোপীয় দেশগুলোর ব্যর্থতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়ে এ বছরের মে মাসে তেহরান চুক্তি থেকে আংশিক সরে আসার ঘোষণা দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সমঝোতা বাস্তবায়নের জন্য দুই মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। সেই সময়সীমা শেষে নতুন করে চুক্তির প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার ঘোষণা এলো।

পরমাণু সমঝোতা রক্ষা করার লক্ষ্যে ইরানের পক্ষ থেকে ইউরোপকে দেওয়া চূড়ান্ত সময়সীমা শেষ হয়েছে শনিবার (৬ জুলাই) রাতে। আর এর একদিনের মাথায় (রবিবার, ৭ জুলাই) তেহরান এ সমঝোতায় নিজেদের দেওয়া আরও কিছু প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে বলেন, কূটনৈতিকভাবে ইরান যথেষ্ট সময় দিয়েছে। তবে ইউরোপীয় দেশগুলোর সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে।

ট্রাম্প ও রুহানি
এর আগে শনিবার রাতে ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। সে সময় আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলো যথাযথভাবে পালনের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান রুহানি। ফরাসি প্রেসিডেন্ট পরমাণু সমঝোতা রক্ষা করার লক্ষ্যে আবার আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিলে হাসান রুহানি বলেন, ইরানের ওপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে আবার ইরানের আলোচনা শুরু হওয়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি হতে পারে।

প্রেসিডেন্ট রুহানি দাবি করেন,যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক চাপ, হুমকি ও নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান গত ১৪ মাস ধরে কৌশলগত ধৈর্য অবলম্বন করে একতরফাভাবে পরমাণু সমঝোতা মেনে চলেছে। কিন্তু এখন সে ধৈর্যের সীমা শেষ হয়ে এসেছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট তার দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চাপ ও নিষেধাজ্ঞাকে ‘সর্বাত্মক অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদ ও যুদ্ধ’ আখ্যায়িত করে বলেন, এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বে নয়া হুমকির জন্ম হতে পারে। তিনি বলেন, ইরান সম্প্রতি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা পরমাণু সমঝোতা অনুসরণ করেই নেওয়া হয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে এ সমঝোতা রক্ষার লক্ষ্যেই এটা করেছে তেহরান। এ অবস্থায় ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিজেদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করে এ সমঝোতা রক্ষার জন্য আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান রুহানি।

টেলিফোন আলাপে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বলেন, শুরু থেকেই তার সরকার পরমাণু সমঝোতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করে এসেছে। তিনি দাবি করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরমাণু সমঝোতা রক্ষা করতে চায় এবং প্যারিস এ লক্ষ্যে তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে ইউরোপ ইরানকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে স্বীকার করেন ম্যাক্রোঁ। এখন থেকে এ লক্ষ্যে আরও বেশি তৎপরতা চালানোর প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই অঞ্চলে একটি এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার, লাখো সেনা ও বি-৫২ বোমারু বিমান পাঠিয়েছে দেশটি। গত মাসে হরমুজ প্রণালির কাছে একটি জাপানি তেল ট্যাংকারে হামলা হয়। একটি মার্কিন সামরিক ড্রোনও ভূপাতিত করে ইরান।