সমুদ্রে কমছে অক্সিজেন, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য

জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের ফলে সাগর-মহাসাগরগুলোতে কমছে অক্সিজেনের পরিমাণ। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মাছের বহু প্রজাতি। পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন-এর বড় ধরনের এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য। ৭ ডিসেম্বর শনিবার এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি।12
বহু দশক ধরেই বিজ্ঞানীরা জানতেন যে, মহাসাগরগুলোতে পুষ্টিমান কমে যাচ্ছে। এখন গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অক্সিজেন হ্রাস পরিস্থিতিকে আরও মারাত্মক করে তুলছে। এতে করে হুমকিতে পড়ছে টুনা, মার্লিন, হাঙ্গরের মতো বহু মাছ। কারণ বড় মাছগুলোর বেশি শক্তির দরকার হয়।

দুনিয়াজুড়ে ৭০০-এরও বেশি সামুদ্রিক এলাকা এখন অক্সিজেন স্বল্পতায় ভুগছে। ১৯৬০ এর দশকে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৫টি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষি খামার ও শিল্প কারখানা থেকে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস সমুদ্রের পানিতে গিয়ে মিশে যাওয়ার ফলেই দূষণের ঘটনা ঘটছে। এটি সমুদ্রের পানিতে থাকা অক্সিজেনের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতোদিন ধারণা করা হতো, এটি শুধুমাত্র উপকূলীয় এলাকার সমুদ্রেই প্রভাব ফেলছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই হুমকির মাত্রা বেড়েছে।

গ্রিন হাউসের ফলে যেহেতু কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই সমুদ্রগুলোকে আরও বেশি তাপ শুষে নিতে হচ্ছে। ফলে উষ্ণ পানি কম অক্সিজেন ধরে রাখতে পারছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ১৯৬০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে সমুদ্রের পানি থেকে দুই শতাংশ অক্সিজেন হারিয়ে গেছে। পুরো দুনিয়ার বিবেচনায় এটা খুব বেশি মনে না-ও হতে পারে। কিন্তু কোনও কোনও গ্রীষ্মপ্রধান এলাকায় এই হার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এমনকি খুব সামান্য পরিবর্তনও সামুদ্রিক জীবনযাত্রার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন কম অক্সিজেন সমৃদ্ধ পানি জেলিফিশের মতো প্রাণীর জন্য উপকারী হতে পারে। কিন্তু টুনা মাছের মতো বড়, দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে, এমন প্রাণীর জন্য সেটি ভালো নয়।

আইইউসিএন-এর কর্মকর্তা মিন্না ইপস বলেন, ‘অক্সিজেন হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি আমরা জানতাম। কিন্তু সেটার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক এবং এটি কতটা হুমকি তৈরি করছে; সেটা আমাদের জানা ছিল না।’

মিন্না ইপস বলেন, ‘গত ৫০ বছরে অক্সিজেন কমে যাওয়ার হার যে শুধু চারগুণ হয়ে গেছে তা-ই নয়, এমনকি যেসব জায়গায় কার্বন নিঃসরণ কম হয়েছে সেখানেও মহাসাগর থেকে অক্সিজেন কমে যাচ্ছে।’

গবেষকরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে টুনা, মার্লিন, হাঙ্গরের মতো অনেক প্রাণী সমুদ্রের ওপরের দিকে এসে থাকতে শুরু করেছে। কিন্তু এতে করে এসব প্রাণী মাছ শিকারিদের সহজ টার্গেটে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতেও পড়ে যাচ্ছে।

বিশ্বের দেশগুলো যদি কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে বরাবরের মতো মনোভাব দেখিয়ে যায়, তাহলে ২১০০ সাল নাগাদ মহাসাগরে অক্সিজেনের মাত্রা ৩-৪ শতাংশ কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গ্রীষ্মপ্রধান এলাকাগুলোতে এই হার হবে আরও অনেক বেশি। বেশিরভাগ ক্ষয়ক্ষতি হবে সমুদ্রের প্রথম এক হাজার মিটারের মধ্যে, যেখানে সবচেয়ে বেশি জৈববৈচিত্র্য রয়েছে। আর কম মাত্রার অক্সিজেনের ফলে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য চক্রের মতো মৌলিক ক্ষেত্রেও হুমকি তৈরি হবে।

মিন্না ইপস বলেন, ‘আমরা যদি সাগর থেকে অক্সিজেন হারিয়ে ফেলি, তাহলে সেখানে প্রাণীগুলোর আবাসস্থল নষ্ট হবে, জৈববৈচিত্র্য নষ্ট হবে এবং আরও বেশি জেলিফিশের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি হবে। এটি মহাসাগরের শক্তি এবং জৈব রাসায়নিক চক্র পাল্টে দেবে। ফলে আমরা এখনও জানি না, এসব জৈববৈচিত্র্য এবং রাসায়নিক পরিবর্তন মহাসাগরের ভেতরে কী পরিবর্তন ঘটাবে?’

এই গবেষণার সহ-প্রণেতা এবং আইইউসিএন-এর গবেষক ড্যান ল্যাফোলে বলেন, ‘মহাসাগরে অক্সিজেন কমে যাওয়ায় সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়েছে। এর ফলে ইতোমধ্যেই ক্ষতির মুখে পড়েছে সামুদ্রিক পরিবেশ।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যাপকভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমাতে হবে। সেই সঙ্গে কৃষি খামার ও অন্যান্য উৎসের ফলে সমুদ্রের যে পুষ্টি-দূষণ হয় সেটাও বন্ধ করতে হবে।’ সূত্র: বিবিসি।