অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলের আগুন নিভছে না কেন?

দাবানল অস্ট্রেলিয়ার জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। স্থানীয়রা একে বুশফায়ার নামে ডাকে। সাধারণত গ্রীষ্মকালে তাপদাহের কারণে প্রতি বছরই সেখানকার জঙ্গলে দাবানল হয়। এবারের দাবানল আগের সব রেকর্ড ও তীব্রতা ছাড়িয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত অন্তত ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে ১২০০ এরও বেশি বসত বাড়ি ও ৫৫ লাখ হেক্টর জমি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এই আগুনের তীব্রতা বাড়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। তবে বরাবরই এই কারণকে এড়িয়ে গেছেন অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন।  জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন দাবি করলেও আদতে পরিবর্তন মোকাবিলায় তেমন কোনও ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি তাকে।

eight_col_fires

দাবানল কতটা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, টেলিভিশনের পর্দায় মাঝেমধ্যেই উঠে আসে তার করুণ চিত্র। আগুনের রোষের মুখে কেবল গাছপালা আর অন্য প্রাণীরা নয়, অসহায় হয়ে পড়ে মানুষও। কখনও সংলগ্ন এলাকা থেকে মানুষজনকে উদ্ধার করা, কখনও আবার দাবানলের পথে গাছ কেটে আগুন থামানোর চেষ্টাতেই অবলম্বন খোঁজেন স্থানীয়রা। সরকারিভাবে বিমান থেকে বিশেষ তরল মিশ্রণ ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টাও করা হয়। তবে সে প্রচেষ্টা সব সময় সফল হয় না। একমাত্র প্রবল বৃষ্টিপাতেই এসব আগুন শান্ত হয়।

অস্ট্রেলিয়ায় গত সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এবারের দাবানল সম্প্রতি মারাত্মক আকার ধারন করেছে। নিউ সাউথ ওয়েলস ও ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যে দাবানল শহরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকায় উপকূলীয় এলাকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে লাখো মানুষ। অঙ্গরাজ্য দুটিতে এখন পর্যন্ত ২৪ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা এই দাবানলে প্রায় ৫০ কোটি প্রাণী মারা গেছে।

দাবানল কেন এত মারাত্মক?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্ট্রেলিয়ার এই ভয়ঙ্কর দাবানল মূলত তীব্র তাপদাহ, অনেকদিন ধরে চলা খরা এবং ঝড়ো বাতাসের কারণে এমন ভয়ঙ্কর রুপ ধারণ করেছে। দেশটিতে অনেকদিন ধরেই তাপদাহ চলছে। বিগত তিন মাসের উষ্ণতা ভেঙে দিয়েছে ১২০ বছরের রেকর্ড। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি দেশটিতে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি গরম অনুভূত হয়। সে সময় গড় তাপমাত্রা ছিলো ৪১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমন পরিস্থিতিতে আগামী কয়েকদিনে আগুনের তীব্রতা কমার সম্ভাবনা কম। এছাড়া এই ঝড়ো হাওয়াতে অস্ট্রেলিয়া বড় শহরগুলোতে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। সোমবার বাতাসের গতিবেগ ছিলো ঘণ্টায় ৬০ মাইল।

অস্ট্রেলিয়ায় চলছে ভয়াবহ খরা। ১২০ বছর আগে থেকে আবহাওয়ার তথ্য নথিভূক্ত করছে দেশটি। তখন থেকে এবারের আগে কখনও বসন্তকালে এমন খরা দেখা যায়নি। ২০১৭ সাল থেকে নিউ সাউথ ওয়েলস ও কুইন্সল্যান্ডের বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়ায় তা শুস্ক হয়ে গেছে। ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে সেখানকার গাছ ও ঘাস নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

https___cdn.cnn.com_cnnnext_dam_assets_191119131842-03-australia-bushfires-1119-restricted

 

আগুন নেভাতে কি করা হচ্ছে?

পরিস্থিতি মোকাবিলায হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবীর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াকে। আগুনের নিকটবর্তী বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মোতায়েন করা হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদেরও। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও নিউ জিল্যান্ডও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আগুন নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। আগুনের ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চল ও মানুষের আবাসস্থলের মাঝে দূরত্ব তৈরি করতে হবে। মাঝে একটি বাফার জোন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভবন তৈরির নীতিমালাও জোরদার করা দরকার।  এছাড়া আগুন মোকাবিলা পদ্ধতির সংস্কার দরকার।  স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর ভরসা না করে অর্থ খরচ করে নতুন পদ্ধতি শুরু করতে হবে। সেখানকার আদিবাসীরা যেই পদ্ধতি অনুসরণ করে সেটাতেও জোর দেওয়া যেতে পারে।

এই আগুনের জন্য কি জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী?

অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল একটি নিয়মিত ঘটনা। প্রায়ই বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক ঘটনায় কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত বছরগুলোতে আগুনের তীব্রতা যেভাবে বেড়েছে সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত। জলবায়ু পরির্তনে অস্ট্রেলিয়ার আরও শুষ্ক ও উষ্ণ হয়ে উঠেছে। আর সে কারণেই আগুন সেখান আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারছে।

দেশটির আবহাওয়া অধিদফতরের মতে, ১৯২০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়ারের চেয়েও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এটি বৃদ্ধির মাত্রা গতি পেয়েছে ১৯৫০ সাল থেকে।

২০১৮ সালে প্রকাশিত কুইন্সল্যান্ডের এক গবেষণায় দেখা যায়, মানবসৃষ্ট কারণের চেয়ে উষ্ণ তাপমাত্র এই আগুনের ক্ষেত্রে চারগুণ বেশি দায়ী। জাতীয় পরিবেশ বিজ্ঞান প্রকল্প জানায়, ভবিষ্যতে আগুনের মাত্রা বাড়বে। আর এটা হচ্ছে গ্রিন হাউস গ্যাস বৃদ্ধির কারণে।

মরিসন অবশ্য দাবি করেন, তার সরকার সবসময়ই জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্ব দিয়েছে। তবে বাস্তবতা সে কথা বলে না। যে কার্বন ট্যাক্সের কারণে ২ বছরে দেশটির গ্রিনহাউস গ্যাস ১.৪ শতাংশ কমে গিয়েছিলো, ২০১৪ সালে তা সংস্কার করে তার সরকার। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও জলবায়ু নীতির কারণে সমালোচিত হয়েছেন তিনি। জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে মরিসনের প্রতিনিধিদল কার্বন কমানোর পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন।

কেন সমালোচনার শিকার অস্ট্রেলিয়া?

দাবানল মোকাবিলা নিয়েও সমালোচনার শিকার হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সরকার। সেখানে নিয়মিত এই ঘটনা ঘটলেও কেন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না; সেই প্রশ্ন উঠছে। মরিসন বলেছেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তার মনে হয়েছে জাতীয় পার্কে জ্বালানি ব্যবস্থাপনাই বেশি জরুরি। তার মতে, যারা এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলছেন, তারা আসলে এই পরিস্থিতিতে দ্রুত আগুন নেভানোর কথা কিছু বলছেন না। তারা জরুরি বিষয়টা বুঝছে না। তাসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আগুন গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ডেভিড বাওমেন অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানকে ‘খুবই দুর্বল রাজনৈতিক অজুহাত’ আখ্যা দিয়েছেন।