মোদির ঢাকা সফরের প্রস্তুতি: পাকিস্তানি তৎপরতায় চিন্তিত ভারত

নরেন্দ্র মোদি 

মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় আসার কথা রয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। সেই সফরের প্রাক্কালে ভারতের পক্ষে যাবতীয় প্রস্তুতির তদারকি করতে আজ (সোমবার) ঢাকায় আসছেন ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।     

সোমবার (২ মার্চ) স্থানীয় সময় সকাল ন’টা নাগাদ একটি বেসরকারি সংস্থার বিমানে তার ঢাকায় পৌঁছানোর কথা। সেখানে পৌঁছে তিনি ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যেমন বৈঠক করবেন, তেমনি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী, নীতিনির্ধারক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গেও নরেন্দ্র মোদির আসন্ন সফর নিয়ে আলোচনা করবেন।

তবে এই প্রস্তাবিত সফরের আগে দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামপন্থী গোষ্ঠী ও বামপন্থী দল যেভাবে নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতায় পথে নেমেছে, তা কিছুটা হলেও ভারতকে বিচলিত করেছে।

ভারতের গোয়েন্দা সূত্রগুলো মনে করছে, এক্ষেত্রে অন্তত ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর রাস্তায় নামার পেছনে আর এক প্রতিবেশী পাকিস্তানের প্রচ্ছন্ন মদত থাকতে পারে।

ক্যাবিনেট সচিবালয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার কথায়, ‘সাম্প্রতিক অতীতে যেভাবে আমরা বাংলাদেশের মাটিতে ভারতবিরোধী এজেন্ডা নিয়ে পাকিস্তানকে নতুন করে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করতে দেখেছি, তাতে এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। যদিও শেখ হাসিনা সরকার পাকিস্তানি অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সদা তৎপর, তারপরও এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের সাবধান থাকতেই হচ্ছে!’

বস্তুত কেন পাকিস্তানের এই ‘সক্রিয়তা’ নিয়ে ভারত নতুন করে চিন্তিত, তার পেছনে অনেকগুলো কারণও দেখানো হচ্ছে।

এক. কেন ঘন ঘন বাংলাদেশে যেতেন দেবিন্দর সিং :

গত জানুয়ারি মাসে তিনজন হিজবুল মুজাহিদিন জঙ্গির কাছ থেকে মোটা অর্থ নিয়ে নিজের গাড়িতে করে তাদের ‘ফেরি’ করার সময় ধরা পড়েন জম্মু ও কাশ্মির পুলিশের একজন ডিএসপি দেবিন্দর সিং। পরে তাকে জেরা করতে গিয়ে ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) জানতে পারে, গত বছরেই অন্তত তিনবার ঢাকায় গিয়েছিলেন ওই শিখ পুলিশ অফিসার। আর প্রতিবারই বেশ কয়েকদিন ছিলেন সেখানে।

কারণ হিসেবে তিনি যদিও বলেছেন তার দুই মেয়েই বাংলাদেশে মেডিক্যাল কলেজে পড়ত, এক বছরে মেয়েদের আনতে বা রেখে আসতে তিন তিনবার ঢাকায় যাওয়া ও প্রতিবার বেশ কয়েকদিন থেকে আসা স্বাভাবিক নয় কোনোমতেই। ভারতীয় গোয়েন্দারা সন্দেহ করছেন, ঢাকাতে বসেই পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন দেবিন্দর।

দুই. কেন কাশ্মির নিয়ে রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজন করছে পাকিস্তান হাই কমিশন:

সম্প্রতি ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান হাই কমিশনের পক্ষ থেকে কাশ্মির বিতর্কের নানা দিক নিয়ে রচনা প্রতিযোগিতা ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। এতে বাংলাদেশের নানা বয়সের ছাত্রছাত্রীদের যোগ দিতে আহ্বান জানানো হয়। পরে পাকিস্তানের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইমরান আহমেদ সিদ্দিকি ওই প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কারও তুলে দেন। সেই অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেন কাশ্মির কখনোই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল না।

কাশ্মিরের মতো একটি সংবেদনশীল বিষয়কে পাকিস্তান যেভাবে একটি তৃতীয় দেশের মাটিতে খুঁচিয়ে তুলতে চাইছে–সেই পদক্ষেপকে স্বভাবতই ভারত ভালো চোখে দেখছে না। জি এম কাদেরের মতো বাংলাদেশের বহু প্রথম সারির রাজনীতিকও পাকিস্তান দূতাবাসের এই আচরণের নিন্দা করেছেন। ভারত মনে করছে, কাশ্মির-সংশ্লিষ্ট এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে পাকিস্তান বাংলাদেশের ভেতরেও ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

তিন. গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের জামায়াত নেতাদের পক্ষে পোস্টার

সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয় দল যখন নানা বিতর্ক ও জল্পনার পর পাকিস্তানের মাটিতে আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলতে গিয়েছিল, তখন লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে একদল পাকিস্তানি তরুণ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের জন্য ফাঁসি হওয়া জামায়াতে ইসলামী নেতাদের সমর্থনে নানা ফেস্টুন ও পোস্টার তুলে ধরেন। ম্যাচগুলো বাংলাদেশেও সরাসরি সম্প্রচার হওয়ার সুবাদে সে দেশেও লাখ লাখ মানুষ টিভির পর্দায় সে দৃশ্য দেখেছেন। পরে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

ভারতীয় কর্মকর্তারা মনে করছেন, বাংলাদেশে ইসলামপন্থী ও স্বাধীনতাবিরোধী যে শক্তিগুলোকে পাকিস্তান বরাবর মদত দিয়ে এসেছে, গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে জামায়াতের পক্ষে এই ‘অ্যামবুশ মার্কেটিং’-ও ছিল সেই পরিকল্পনার অংশ।

এই ধরনের নানা দৃষ্টান্ত দিয়েই তারা বলার চেষ্টা করছেন, বাংলাদেশের ভেতর ভারতবিরোধী প্রোপাগান্ডা চালানোর জন্য পাকিস্তান নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে এবং নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর বানচাল করাও তাদের অন্যতম লক্ষ্য।

‘তবে আমরা এটাও জানি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার সেই ষড়যন্ত্র কিছুতেই সফল হতে দেবেন না। পররাষ্ট্র সচিবের বর্তমান সফর দুই দেশের সম্পর্কের ভিতকেই আরও মজবুত করবে’, বলছিলেন দিল্লির নর্থ ব্লকের ওই পদস্থ সূত্রটি।