প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় বৈরুত বিস্ফোরণের ভয়াবহতা

মঙ্গলবার (৪ আগস্ট) বড় ধরনের বিস্ফোরণের পর পাল্টে গেছে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের চেহারা। শহরের একটি বিশাল অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মূল বিস্ফোরণস্থলের কয়েক কিলোমিটার দূরের ভবনও। এ ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানুষদের চোখের সামনে এখনও ভেসে উঠছে সে ভয়াবহতার দৃশ্য। তাদেরই কয়েকজন কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার কাছে নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।

মরিয়ম নুন

২২ বছর বয়সী মরিয়ম নুন একটি এনজিওতে প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করছেন। ঘটনার দিন রোচে এলাকায় ছিলেন তিনি। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘বৈরুতের রোচে জেলায় একটি ক্যাফেতে আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎই মাটি কেঁপে উঠলো।  বাতাস প্রচণ্ডরকমে ঘূর্ণিপাক খেতে লাগলো। প্রচণ্ড শব্দে আমাদের কান বন্ধ হয়ে গেলো। আমি ভেবেছি ইসরায়েল বোধহয় আমাদের উপর হামলা চালিয়েছে এবং যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমি সাগরের পাশেই ছিলাম। ভাবছিলাম, যেভাবে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, তাতে সলিল সমাধি হবে। লোকজন ক্যাফে ছেড়ে দৌড়াতে লঅগলো। আমরা বাড়ি যাওয়ার জন্য গাড়ির কাছে ছুটে গেলাম। রাস্তাগুলো গাড়ি আর ভাঙা কাঁচে ভরপুর ছিল। বৈরুত ভেঙে পড়েছে, খোদা মানুষের সহায় হোন। আমার কানে এখনও চাপ অনুভূত হচ্ছে।’

তৌফিক নাসার

৩২ বছর বয়সী তৌফিক নাসার আইটি নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি বাড়িতে বাবার সঙ্গে সোফায় বসে ছিলাম। হঠাৎই সবকিছু ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমরা সবাই মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম। এরপর জানালাগুলো ভেঙে পড়তে শুরু করলো। স্লো মোশনের মতো মনে হচ্ছিলো, সবকিছু ভেঙে পড়ছিলো। ওয়াইনের বোতলগুলো তাক থেকে পড়ে যাচ্ছিলো। পুরো ভবনের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিলো ভূমিকম্প হচ্ছে। আশেপোশের সবকিছু বিস্ফোরিত হচ্ছিলো। আমরা প্রতিবেশির বাড়িতে লাফিয়ে পড়লাম। তিনি এক বয়স্ক নারী। তার অক্সিজেন ট্যাংক আলমারির নিচে আটকা পড়েছে। আমাদেরকে তাকে সাথে নিতে হবে। সেখানে থাকা একটি গ্যাস বোতল আমরা তাড়াতাড়ি বন্ধ করলাম। ভবনটি পুরনো, এখান থেকে বের হতে অনেক কাজই করতে হবে। আমি একবার দেখে নিলাম পরিবারের সবাই ঠিক আছে কিনা। এরপর সবকিছু পরিষ্কার করতে লাগলাম।

ফাহাদ হাসান

২১ বছর বয়সী ফাহাদ হাসান লেবাননের ডেন্টিস্ট্রির শিক্ষার্থী। তার গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছিলো। বিস্ফোরণের সময়কার স্মৃতি বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘আমি তখন টিভি দেখছিলাম। শুরুতে বিকট এক শব্দ হলো। মনে হলো সব জায়গা থেকে আওয়াজ আসছে। প্রচণ্ড শব্দের পাশাপাশি আমরা অনুভব করলাম সবকিছু কাঁপছে। এরপর সব পড়ে যেতে লাগলো: গ্লাস, দেয়াল, টেলিভিশন সবকিছু। আমি ১০ সেকেন্ড মেঝেতে আঘাত করলাম। এর পর কী ঘটছে তা দেখার জন্য ব্যালকনিতে গেলাম। দেখলাম, আকাশে যেন লাল মেঘ জমেছে। দুই ঘণ্টা পর আমার মা-বাবা আমাকে রাস্তায় নামতে দিলেন। আমি আহতদের সাহায্য করেছি। রক্তদানও করেছি।’

হাসান হোমসি

৫৫ বছর বয়সী হাসান হোমসি একটি ফুড কার্ট-এর মালিক। লেবানন যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। তিনি জানান, বিস্ফোরণের ঘটনাটি যুদ্ধস্মৃতিকেই ফিরিয়ে এনেছে। হোমসি বলেন, ‘রাস আল নাবেহ এলাকায় বোনের বাড়িতে ছিলাম, কফি পান করছিলাম আমি। তখনই আমরা বিস্ফোরণের শব্দ পেলাম। খুব বিকট শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে কাঁচগুলো ভেঙে পড়লো। আমরা দেখলাম, মাটিতে হতাহতরা পড়ে আছে। লেবানন যুদ্ধের গোটাটাই আমরা দেখেছি। সেকারণে আমার কাছে এটা স্বাভাবিক ছিল। মনে হচ্ছিলো অতীতের কোনও সময়ে ফিরে গেছি। আহতদের সাহায্য করতে গিয়ে যে রক্ত লেগেছে তার গন্ধ এখনও কাপড় থেকে যায়নি।  আমার খুব কষ্ট লাগছে। এ অসহায় মানুষগুলোর জন্য খারাপ লাগছে।’

আলি শেখ

২০ বছর বয়সী আলি শেখ পারিবারিক ক্যাফেতে কাজ করেন। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে ক্যাফেতে ছিলাম, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কোনও ভোক্তা সেখানে ছিলেন না। হঠাৎ কম্পন অনুভূত হলো, আমরা বললাম, সমস্যা নেই, ভূমিকম্প হচ্ছে, ঠিক হয়ে যাবে।’ তারপর হঠাৎই আমাদে গায়ের উপর গ্লাস এসে পড়লো, টিভি উড়ে হেলো এবং আমাদের কাপগুলো সব ভেঙে গেলো। আমার বাবা আহত হলেন। আমার মনে হলো একেবারে যেন ক্যাফের সামনেই বিস্ফোরণ হয়েছে। সবারই তাই মনে হচ্ছিলো, বিস্ফোরণটি খুব শক্তিশালী ছিল। আমরা বাড়ি ফিরে দেখলাম সব কাঁচ ভেঙে আছে।’