ইরানে ৭৩ কিশোর-কিশোরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পেছনের গল্প

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সময়কালে ইরানে অন্তত ৭৩ জন অপ্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। আর দণ্ড কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে ১৬০ জন। কথিত অপরাধীদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই ধর্ষণ, খুন ও মাদক সম্পর্কিত অপরাধের অভিযোগ থাকলেও অ্যামনেস্টির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের মধ্য দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়। অপ্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান বহাল রয়েছে ইরানে
অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে ইরান। ওই প্রতিবেদনে বলা হয় ২০১৫ সালের শুরুতেই অন্তত ৭০০ নাগরিককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে দেশটিতে।
প্রতিবেদনের প্রধান গবেষক রাহা বাহরেইনি ওয়ার্ল্ডপোস্টকে বলেন, ‘পুরো পরিস্থিতি জঘন্য ও পীড়াদায়ক। সবচেয়ে কষ্টকর হচ্ছে, যেখানে বিশ্বের বেশিরভাগ রাষ্ট্রই শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে বাতিল করছে, সেখানে ইরান ৯ বছরের মেয়ে আর ১৫ বছরের ছেলেদেরও মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে।’
যে ৭৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মাকওয়ান মলউজাদে। তিনি যখন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন তখন তার বয়স ছিল ১৩। তার দণ্ড কার্যকর হয় ৮ বছর পর, ২০০৭ সালে। মাকওয়ানের বিরুদ্ধে ‘জোরপূর্বক পুরুষে-পুরুষে পায়ুপথে সঙ্গম’ করার অভিযোগ ছিল। পরে তিনি আদালতে দেওয়া জবানবন্দি প্রত্যাহার করেন। তাকে জোরপূর্বক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল বলেও দাবি করেন তিনি। তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা অপর দুই কিশোরও জানায় পুলিশি অত্যাচারের কারণেই মিথ্যা অভিযোগ করেছিল তারা।

জানাত মির নামের আরেক আফগান কিশোরকে ২০১৪ সালে মৃত্যুদণ্ড দেয় ইরানের আদালত। জানাতকে তার বন্ধুর বাড়ি থেকে মাদক বিরোধী এক অভিযানে গ্রেফতার করে পুলিশ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী মিরকে আইনজীবীর সাহায্য নিতেও দেওয়া হয়নি।

56a91f511f00007f00216c94ইরান জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ডে সাক্ষর করে ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ডে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারা প্রতিনিয়তই সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যাচ্ছে।
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের অনেক কিশোর অপরাধী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে করতে কারাভ্যন্তরেই মৃত্যুবরণ করে। অনেকে এক দশকেরও বেশি সময় কাটিয়ে দেয় কারাগারে। শিশু অপরাধীদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই ধর্ষণ, খুন ও মাদক সম্পর্কিত অপরাধের অভিযোগ থাকে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক প্রধান বউমেদউহা বলেন, ‘প্রতিবেদনটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক এক চিত্র তুলে ধরেছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীরা ব্যাপক হারে মারা যাচ্ছে আর তাদের জীবনের মূল্যবান সময় কারাভোগ করছে। অবিচার, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় ও অন্যান্য অত্যাচার ও নিপীড়ন তো রয়েছেই।’


জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান নাভি পিল্লাই ২০১৪ সালের জুন মাসে ইরানের প্রতি বাল্যবিবাহ ও নিপীড়নমূলক দাম্পত্যের শিকার এক বালিকাবধূর বিরুদ্ধে স্বামীহত্যার দায়ে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান। সে সময় তিনি বলেন, ‘এই মৃত্যুদণ্ড ইরানের বিচারব্যবস্থায় অপ্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার এই নিন্দনীয় বিধানটিকে আরও একবার সামনে আনলো। অপরাধীর পরিস্থিতি বিচার না করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের এইভাবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।’
ইরান ইসলামিক পেনাল কোডের সংস্কার শুরু করেছে ২০১৩ সালে। সে সময় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে অপরাধীর মানসিক অবস্থা ও পরিপক্বতা বিবেচনায় এনে শাস্তি দেওয়ার বিধান দেয়। এ ছাড়া পুনর্বিচারের বিধানও দেওয়া হয় ওই সংশোধনীতে।
তা সত্ত্বেও এখনও অনেক ইরানি কিশোর পুনর্বিচারের প্রক্রিয়া পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না বলে জানানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
গবেষক বাহরেইনি ওয়ার্ল্ডপোস্টকে বলেন, ‘ইরান একটি আংশিক সংশোধনী করেই এর উদযাপন শুরু করেছে। আমরা ইউরোপের নেতাদের ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি এই প্রসঙ্গটি সামনে আনতে। অপ্রাপ্তবয়স্কসহ সকল অপরাধীর জন্য মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করতে তেহরানকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।’ সূত্র: হাফিংটন পোস্ট 

/ইউআর/বিএ/