১৭১ বছর আগে পদ্মা শাসন করেছিলেন শিবচন্দ্র!

বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার উদ্বোধন করেছেন বাংলাদেশের গর্বের পদ্মা সেতু। অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই হয়েছে সেতু। কিন্তু আজ থেকে ঠিক ১৭১ বছর আগে অবিভক্ত ভারতবর্ষে সিপাহী বিদ্রোহেরও আগে খরস্রোতা পদ্মা নদীর নিচ দিয়ে কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন নিয়ে গিয়ে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লিখেছিলেন আর এক বাঙালি শিবচন্দ্র নন্দী।

উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজে প্রথম রসায়ন ও মেটিরিয়া মেডিকার অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন উইলিয়াম ও’শনেসি। ১৮৫১ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে অনুমতি নিয়ে তিনি প্রথম শুরু করেন টেলিগ্রাফের লাইন বসানোর কাজ।

কলকাতার টাঁকশালে কাজের সূত্রে শিবচন্দ্র নন্দীর সঙ্গে আলাপ হয় তার। শিবচন্দ্র ছিলেন কারিগরি বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ। এই দক্ষতা দেখে ও’শনেসি টেলিগ্রাফ বসানোর কাজে শিবচন্দ্রকে সহকারী করে নেন।

প্রাথমিক পর্যায়ে কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন বসানো হয়েছিল। ১৮৫১ সালে শিবচন্দ্রই ডায়মন্ড হারবার থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে প্রথম বার্তাটি প্রেরণ করেন কলকাতায়। তখন অন্য প্রান্তে কলকাতায় উপস্থিত ছিলেন ও’শনেসির সঙ্গে তৎকালীন ভারতের গর্ভনর জেনারেণ লর্ড ডালহৌসি।

পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে টেলিগ্রাফ লাইন পাতার কাজ করেছিলেন শিবচন্দ্র। প্রথাগত শিক্ষার বাইরেও তার বাস্তব ছিল অসাধারণ। তিনি ছিলেন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার, বলা ভালো ‘প্রথম’ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ভারতবর্ষে টেলিগ্রাফ প্রবর্তকদের মধ্যে অন্যতম। সেই সময় টেলিগ্রাফ পাঠাতে বিদ্যুতের তার লাগানোর জন্য লোহার খুঁটি সুদূর ইংল্যান্ড থেকে আনা হতো। তাতে অর্থ ও সময়— দুটোই ব্যয় হতো অনেক। এই সমস্যার সমাধানের উপায় বের করেন শিবচন্দ্র। দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তালগাছের লম্বা লম্বা গুঁড়িকে এই খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেন তিনি।

এই সময় শিবচন্দ্রের ওপর দায়িত্ব পড়ে কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত ৩২৬ কিলোমিটার টেলিগ্রাফের লাইন বসানোর। কিন্তু এখানে মূল সমস্যা ছিল পদ্মা নদী। এখানকার থেকে তখন পদ্মার রূপ ছিল আরও ভয়াবহ। ওপর দিয়ে নয়, খরস্রোতা এই নদীর তলা দিয়ে সাবমেরিন কেবলের মতো লাইন নিয়ে যাওয়া রীতিমতো অসাধ্য ব্যাপার।

মাটির নিচ থেকে লাইন তোলার জন্য এক চমকপ্রদ উপায়ে তাল গাছের লম্বা লম্বা গুঁড়িকে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে সেই কাজ সম্পন্ন করা হয়।

সরকারি খরচা কমানোর জন্য পদ্মার ওপর লাগাতার বেশ কিছু মাস জেলেদের নৌকায় রাত কাটান তিনি। তিন বার ডাকাতের কবলে পড়েন। এতে একবার তার প্রাণ সংশয়ের অবস্থা হয়। তবু হাল না ছেড়ে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন শিবচন্দ্র। এই কাজ করে তিনি ব্রিটিশ সরকারের ১০ হাজার টাকার সাশ্রয় করেন।

যে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ, শিবচন্দ্র নন্দী ছিলেন তার অন্যতম প্রধান স্থপতি। এই কাজের স্বীকৃতির জন্য ১৮৮৪ সালে তাকে ব্রিটিশরা রায় বাহাদুর উপাধি দেন। কলকাতার বউবাজারে একটি গলি ‘শিবু নন্দীর লেন’ নামে তার নামটি বাঁচিয়ে রেখেছে। ১৮৫২-৫৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে পূর্ব বরাকর, বরাকর-এলাহাবাদ, বারাণসী ও বারাণসী থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত ৯০০ মাইল টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপনের সময় শোন নদীতেও অনুরূপভাবে তাল গাছের গুঁড়িকে খুঁটি হিসাবে ব্যবহার করেন।

শিবচন্দ্র নন্দীর দেশীয় উদ্ভাবনী কৌশলে তাল গাছের গুঁড়িকে খুঁটি হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশিকা টেলিগ্রাফ ম্যানুয়ালে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। স্যার রোপার লেথব্রিজের লেখা গ্রন্থ ‘দ্য গোল্ডেন বুক অব ইন্ডিয়া’-তে শিবচন্দ্রের এই কাজের উল্লেখ পাওয়া যায়।

এশিয়াটিক সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করা এই বাঙালি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের শেষ জীবন অতিবাহিত হয়েছিল কষ্টের মধ্যে। সেই সময় কলকাতায় প্লেগ রোগ মহামারির আকার নিয়েছিল। এই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে ১৯০৩ সালে ৬ এপ্রিল মারা যান শিবচন্দ্র নন্দী। যেদিন মারা যান, সেদিন কলকাতার সব টেলিগ্রাফ অফিস বন্ধ ছিল। আজ স্থলপথে পদ্মা জয়ের ইতিহাসে আমরা যেন ভুলে গিয়েছি ১৭১ বছর আগের শিবচন্দ্রকে, যিনি টেলিগ্রাফের তার দিয়ে প্রথম পদ্মাকে জয় করার সাহস দেখিয়েছিলেন।