আলোকচিত্র-সাংবাদিক লিনসি আদারিও এবং যুদ্ধে বিপন্ন নারীদের নিয়ে তার ১৬ বছরের লড়াই
গৃহযুদ্ধ থেকে শরণার্থী সঙ্কট কিংবা সুদান থেকে পাকিস্তান। বিশ্বজুড়ে দক্ষ হাতে ক্যামেরা নিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো একজন আলোকচিত্রী লিনসি আদারিও। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ডেইলি নিউজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসে (ডিএনএ) অমৃতা মধুকল্যাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে একজন নারী সাংবাদিক হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতার কথা।
২০০০ সালে তালেবানের অধীনে থাকা আফগানিস্তানের বাস্তবতা তুলে ধরার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন আদারিও। তিনি জানান, ‘তারপর থেকে আমি ইরাক, দারফুর, কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান, লেবানন, লিবিয়া এবং সিরিয়ার যুদ্ধ বাস্তবতাকে ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা করেছি।’ ৪২ বছর বয়সী এই নারী ছবি তুলেছেন নিউ ইয়র্ক টাইমস, টাইম ম্যাগাজিন, নিউজ উইক, লাইফ, গেটে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি-সহ নামিদামী সব সংবাদমাধ্যমের জন্য। যুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী বাস্তবতায় সংঘর্ষ কবলিত এলাকার নারী ও শিশুদের সংগ্রামী জীবনের ছবি ক্যামেরায় ধরতে চেয়েছেন তিনি। ডিএনএ-কে তিনি বলেন, ‘আমি দেখতে চেয়েছি, নারী আর শিশুরা কিভাবে যুদ্ধের বলি হন। আমি বুঝতে চেয়েছি বেসামরিক বাস্তবতা। যুদ্ধে যারা জড়িত নন, তাদের ভোগান্তি বোঝার চেষ্টা করেছি আমি।’
ইরাকে সাংবাদিকতার সময় ২০০৪ সালে তিনি আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট এক বিদ্রোহী গ্রুপের হাতে অপহৃত হন। ২০১১ সালে অপহৃত হন গাদ্দাফির বাহিনীর হাতে। ‘লিবিয়ায় দুর্দান্ত সেই গণজাগরণের সময়, গাদ্দাফি বাহিনীর লোকেরা আমাকে ধরে নিয়ে যায় এবং এক সপ্তাহ আটকে রাখে। সে সময় আমাকে বেঁধে রাখা হয়, আমার চোখ বেঁধে রাখা হয়, আমাকে পেটানো হয়। সেখানকার সব পুরুষই আমার শরীরে হাত দিয়েছে। আমার পোশাক ছিঁড়ে নিয়েছে। পুরো সময়টাতেই আমি ধর্ষণের ভয়ে ভীত ছিলাম। যেহেতু ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি হাতে ক্যামেরা তুলে নিয়েছিলাম, সেহেতু আমার ধর্ষিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম।’ অমৃতাকে বলেন আদারিও।
এখানেই শেষ নয় আদারিওর বিপদে পড়ার গল্প। পাকিস্তানের পেশাওয়ারেও তালেবানের আক্রমণের শিকার হয়েছেন তিনি। ২০০৯ সালে ইসলামাবাদের শরণার্থী শিবিরে সংবাদ সংগ্রহ শেষে আরও কজন সাংবাদিকের সঙ্গে ফেরার পথে ওই গাড়ি উল্টে গেলে আদারিওর এক সহযোদ্ধা সাংবাদিক নিহত হন। সেই দুর্ঘটনায় আদারিওর গলার হাড় ভেঙে যায়। একমাসেরও বেশি সময় হাসপাতালে থাকতে হয় তাকে।
লিনসি আদারিওর আলোচিত বই ‘আমি যা করেছি’ (It’s What I Do) তার ১৬ বছরের কর্মময় জীবনের এক দুর্দান্ত স্বাক্ষর। এটি একটি বেস্ট সেলার। এই বই থেকে স্টিভেন স্পিলবার্গ ওই বই থেকে একটি সিনেমা বানাতে চান, যেখানে আদারিওর ভূমিকায় জেনিফার লরেন্সের অভিনয় করার কথা। আদারিও বলেন, ‘বইটায় আমি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো লুকোতে চেষ্টা করিনি, বিশেষত যুদ্ধকালে নারীদের যেসব বঞ্চনা পোহাতে হয় সেগুলোর কিছুই আমি লুকাইনি। আমি একজন সংবাদকর্মী এবং কিছু লুকিয়ে রাখা আমার জন্য লজ্জার।’
গর্ভবতী থাকা অবস্থাতেও সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সংবাদ (আলোকচিত্র) সংগ্রহ করেছেন আদারিও। এখন তিনি কাজ করছেন সিরীয় শরণার্থীদের নিয়ে। শরণার্থী নারী ও শিশুদের ক্যামেরায় ধারণ করে তিনি দেখাতে চাইছেন তাদের জীবনের বঞ্চনা আর বিপন্নতা। নিউ ইয়র্ক টাইমসে তার একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের নাম ‘একজন ঘরহারা’ ('The Displaced')। এতে তিনি তুলে এনেছেন লেবাননের শরণার্থী শিবিরে থাকা হেনা নামের এক ১২ বছর বয়সী শিশুর বিপন্নতার গল্প।
আদারিও জানান, ‘সিরীয় শরণার্থীদের নিয়ে আমি ২০১২ সালে কাজ শুরু করি। তখন থেকেই আমি ইরাক, তুরস্ক, লেবানন, জর্দান সব জায়গায় থাকা সিরীয় শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। খুব সম্প্রতি আমি ইউরোপে আসতে থাকা শরণার্থীদের নিয়ে কাজ শুরু করেছি। তারা এক ভয়াবহ যুদ্ধ বাস্তবতাকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে। বিপন্ন হয়েছে শিশুদের শৈশব। তারা শিশুরা স্কুল ত্যাগে বাধ্য হয়েছে। এখন তাদের জায়গা হয়েছে বস্তিতে। যখন তাদের খেলে বেড়ানোর কথা, তখন তারা স্মরণ করতে বাধ্য হচ্ছে ক’দিন আগে ছেড়ে আসা এক ভয়াবহ অতীত। এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ বাস্তবতা। সে কারণেই তাদের অনেকেই মানসিক আতঙ্কের রোগে (ট্রমা) ভুগতে শুরু করেছে।’
অমৃতার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে গিয়ে আদারিও জানিয়েছেন এক আবেগময় অভিজ্ঞতা। যখন ছবিতে হেনার জীবনের গল্প লিপিবদ্ধ করছেন তিনি, তখন হেনার সঙ্গে এক মানসিক পরামর্শ কেন্দ্রে গিয়েছিলেন তিনি। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ওই শিশুদের যখন বলা হয়, যাকে তোমরা ভালোবাসো তার ছবি আঁক তখন এক শিশু আদারিওর ছবি এঁকেছিলেন। শিশুটি আদারিওকে বলেছিলেন, ‘এটা তোমার জন্য। তোমাকে ভালোবাসি, কেননা তুমিই আমাদের বিপন্নতার গল্প তুলে ধরেছ।’ বিষ্ময়ভরা আবেগাপ্লুত কণ্ঠে আদারিও জানান, মানসিক ওই চিকিৎসা কেন্দ্রে তাকে জানানো হয়েছে, ওই শিশুটি নাকি এক বছর পর সেদিন কথা বলেছিল প্রথমবারের মতো। শরণার্থী জীবনের সবচে ভয়াবহতা হলো তাদের কেউ সাদরে আমন্ত্রণ করে না, অমৃতাকে বলেন হেনা। বিপুল পরিমাণের দাসত্ব ও বঞ্চনা সহ্য করতে হয় তাদের।
আদারিও সব সময় তার সংবাদচিত্রে মানবীয় আর্তি তুলে ধরতে চেয়েছেন। সৎ এবং মুক্ত সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে পৃথিবীটা বদলে দেওয়া সম্ভব বলেই মনে করেন তিনি। আদারিওর মত, সংবাদচিত্রে মানবিক আর্তি ফুটিয়ে তুলে মানুষকে কোথাও থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করা যায়, বাধ্য করা যায় চিন্তা করতে।
রাজা বেনাউট এবং যুদ্ধে শরণার্থী হওয়া নারীদের নিয়ে তার সম্মিলিত সঙ্গীতের লড়াই
৬০ বছর বয়সী এক সিরীয় নারী রাজা বেনআউট। সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ-প্রতিরোধের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন তিনি। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি বিস্মিত যে এখনও আমাদের চোখের জল ফুরিয়ে যায়নি।’
বেনাউটের দুই মেয়ে এবং একজন নাতি থাকে জার্মানিতে, আরেক মেয়ে সুইজারল্যান্ডে আর অর্থনীতিবিদ স্বামী থাকেন দোহায়। স্মৃতি হাতড়ে ফেরেন তিনি। স্মরণ করেন সিরীয় সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার নাজি জার্ফকে। প্যারিসে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে তুরস্ক ছাড়ার আগের রাতে তার সম্মানে এক রাতের খাবারের পার্টির আয়োজন করেছিলেন বেনাউট। সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র সুন্নিপন্থী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের বিরুদ্ধে কলম ধরার কারণে পরদিন সকালে গুলি খেয়ে মরতে হয় ওই সাংবাদিককে। তার আর বিমানে ওঠা হয়নি।
এরপর থেকেই সঙ্গীতকে প্রতিরোধের অস্ত্র করে তোলেন বেনাউট। তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের এক ছোট্ট বাড়িতে গানকেই সঙ্গী করেন তিনি। তুরস্কে থাকা সিরীয় শরণার্থী নারীদের কণ্ঠেও তিনি তুলে দিতে চেয়েছেন ওই গানের অস্ত্র। যেন তাদের হৃদয়ে দৃঢ়তা আসে, যেনও তারা বেদনা লুকাতে পারে গানের অন্তরালে।
বেনাউট সঙ্গী করেছেন হেনান নামের এক ঐতিহ্যগত সিরীয় সঙ্গীতকে, যে হেনান শব্দটির মধ্য দিয়ে স্মৃতিকারতাকে নির্দেশ করা হয়। নারীরা সম্মিলিতভাবে এই সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকেন। সিরিয়ার দামেস্ক, আলেপ্প, হোমস, রাকাসহ বিভিন্ন শহর থেকে আসা বিভিন্ন ভাষার আর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা এখন সবাই তুরস্কের গাজিয়ানটেপের শরণার্থী জীবন যাপন করছেন; তারা সবাই গাইছেন বেনাউটের প্রেরণায়। আরবি, কুর্দি, সিরিয়াক, আর্মেনিয়ানসহ নানান নিজস্ব ভাষাকে সঙ্গী করে। সিরিয়ার বৈচিত্র্যকেও সামনে আনতে চেয়েছেন বেনাউট। তার আশাবাদ সঙ্গীত এই বৈচিত্র্যকে সামনে এনে বিভক্তিকে মোকাবেলা করবে।
ভয়েস অব আমেরিকাকে তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ-বেদনা-ভোগান্তিকে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে মোকাবেলা করার চেষ্টা করছি। নারীদের আমি বলেছি যে, আমাদের গাইতে হবে। তারা আমাকে বলেছে, এ কেমন কথা, তুমি পাগল, যুদ্ধের মধ্যে গান গাইতে বলছ। আমি নারীদের বলেছি, যুদ্ধ বলেই আমাদের গাইতে হবে।’
৫ বছরের গৃহযুদ্ধের আগে খুবই সুন্দর জীবন ছিলো বেনাউটের পরিবারের। তাদের ভালো ব্যবসা ছিল। কিন্তু আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পরিবারটি সংঘর্ষে জড়িয়ে যায়। তারপর ভীত হয়ে যান সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে। তখন সিরিয়া ছেড়ে প্রথমে আমিরাত, পরে কাতারে যান তারা। তবুও নিজেদের যন্ত্রণা নিয়ে অতোটা ভাবিত নন বেনাউট। ‘আমরা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হারিয়েছি। তারপরও আমরা ভাগ্যবান। আমরা শিক্ষিত এবং মোটামোটি ভালো জীবন যাপন করতে পারছি।’ এই ভাবনাই তাকে তাড়িয়ে নিয়ে আসে তুরস্কের বিপন্ন শরণার্থীদের কাছে। স্বামীকে কাতারে রেখে একাই তুরস্কে চলে আসেন তিনি। তাকে বলে আসেন, সিরীয় শরণার্থী নারীদের পাশে দাঁড়ানোই এখন তার জন্য একমাত্র জরুরি কাজ।
এইসব সিরীয় শরণার্থী নারীদের হারানোর বেদনাকেই শক্তিতে রূপান্তর করার প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন বেনাউট। ‘বেশিরভাগ সময় আমরা নারীরা যখন গাইছি, তখন আমরা কাঁদছিও। তবে এই সম্মিলিত কান্নায় নারীদের বেদনাবোধের উপশম হয়।’ বেনাউটের বাড়িতে নারীরা যখন অনানুষ্ঠানিক গান করেন তখনই কেবল তারা কাঁদেন। জনসম্মুখে গান পরিবেশনের সময় তারা কাঁদেন না, ধ্রুপদী গ্রিক নাটকে যেমন করে সম্মিলিত সঙ্গীত পরিবেশিত হয়, তেমন করে তারা সিরীয়দের বেদনাকে সম্মিলিত সঙ্গীতে রূপান্তর করেন।
বেনাউট জানান, সম্মিলিত এই সঙ্গীত শরণার্থী নারীদের ক্ষমতায়নেরই এক প্রক্রিয়া। যেসব বিপন্ন পরিবারের কিশোরী মেয়েদের উপসাগরীয় আরব দেশ বা তুরস্কের বেশি বয়সী পুরুষরা বিয়ে করছেন, সেইসব বিয়ের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছেন তিনি। এই বিয়েগুলো আইনের ভিত্তিতে হয় না এবং বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে ওই কিশোরীদের রেখে তাদের স্বামীরা পালিয়ে যায়। এর পাশাপাশি তিনি শরণার্থী নারীদের নিয়ে রাজনীতি ও নারী অধিকারের ওপর কর্মশালারও আয়োজন করে থাকেন। এগুলোর বেশিরভাগই অনুষ্ঠিত হয় ভবিষ্যতের সিরিয়ার রূপরেখা নিয়ে। তার আশাবাদ, সঙ্গীতে যেমন করে বিভিন্ন ভাষা সংস্কৃতি আর বৈচিত্র্য নিয়ে শরণার্থীরা মিলতে পেরেছেন, তেমনি করে ভবিষ্যতের সিরিয়াতেও বৈচিত্র্য নিয়েই একাত্ম হতে পারবেন তারা। সূত্র: ভয়েস অব আমেরিকা, ডিএনএ, উইকিপিডিয়া, ইউএন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইউনিসেফ, ইউএন পপুলেশন ফান্ড, ফরেন পলিসি
/বিএ/এপিএইচ/