নোবেল পাওয়ার জন্যই কি ক্ষ্যাপাটে ট্রাম্প?

বিখ্যাত মার্কিন সঞ্চালক জিমি ফেলনের অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক দীপক চোপড়া একবার বলেছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী। তার মনের মধ্যে একটি আঘাতপ্রাপ্ত শিশু রয়েছে, যাকে তিনি মুক্ত করতে চান। চোপড়ার ধারণা, ওই শিশুটি সবার সম্মান ও ভালোবাসা পাওয়ার জন্য উন্মুখ। এ জন্যই তিনি সময়ে সময়ে বিভিন্ন আগ্রাসী সমাধান নিয়ে সবার সামনে উপস্থিত হন এই আশায় যে তার কৃতকর্মের জন্য মানুষ তাকে বাহবা দেবে।

দীপক চোপড়া। ফাইল ছবি: সিএনবিসি

দীপক চোপড়ার কথাগুলো বর্তমান সময়ে এসে আবারও প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। ট্রাম্পের কয়েকজন সমালোচকের মতে, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একটা নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য নিজেকে জাহির করার কোনও চেষ্টাই বাকি রাখেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। শুক্রবার (২০ জুন) নিজ মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি একটি দীর্ঘ পোস্ট দেন, যা থেকে বিশ্বের অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার পাওয়ার জন্য তার আকাঙ্ক্ষা আবারও ফুটে ওঠে।

ট্রাম্পের দীর্ঘ সেই স্ট্যাটাস। ছবি: ট্রুথ সোশ্যাল

দীর্ঘ ওই পোস্টে তিনি বলেন, আমি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও যৌথভাবে কঙ্গো এবং রুয়ান্ডার মধ্যে সমঝোতার ব্যবস্থা করেছি। শান্তিচুক্তি চূড়ান্ত করতে দুদেশের প্রতিনিধিরা সোমবার ওয়াশিংটন আসছেন। এর মধ্য দিয়ে তাদের দীর্ঘদিনের রক্তারক্তির অবসান হবে।

এরপরই তার লেখায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে। তিনি লিখেছেন, তবে এরপরও আমাকে একটা নোবেল দেওয়া হবে না। ভারত-পাকিস্তান ও সার্বিয়া-কসোভোর মধ্যে যুদ্ধ থামানো, মিসর-ইথিওপিয়ার মধ্যে বাঁধ নিয়ে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর জন্য আমি কিচ্ছু পাবো না। আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সমঝোতার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, যা পুরো অঞ্চলকে ঐক্যবদ্ধ করবে। ইউক্রেন-রাশিয়া, ইরান-ইসরায়েল যেকোনও সংকটে ফলাফল যাই হোক না কেন, আমাকে নোবেল দেওয়া হবে না। তবে মানুষ জানে (আমি এর যোগ্য দাবিদার), আমার কাছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

ওই লেখায় তিনি আরও যোগ করেন, (যা করেছি তার জন্য) আমাকে চার-পাঁচটা নোবেল দেওয়া উচিত ছিল।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার পর থেকেই সম্মাননাটির জন্য তার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেতে থাকে। ‘অসাধারণ কূটনৈতিক সাফল্যের জন্য’ দায়িত্ব নেওয়ার ৯ মাসের মধ্যেই পুরস্কারটি পেয়েছিলেন তিনি। নোবেল পেয়ে ওবামা বলেছিলেন, এই পুরস্কারে ভূষিত আগের অনেক ব্যক্তি আমার চেয়ে বহুলাংশে বেশি অবদান রেখেছেন।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ফাইল ছবি: রয়টার্স

তার ওই কথাটির প্রতি ইঙ্গিত করে, ২০১৯ সালে একবার ট্রাম্প বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরই ওবামাকে নোবেল দেওয়া হয়। তার নিজেরও ধারণা ছিল না কেন তিনি এটি পেলেন। এই একটি ক্ষেত্রে আমি ওবামার সঙ্গে একমত।  

২০২৪ সালের নির্বাচনি প্রচারণার শেষ দিকে তিনি বলেছিলেন, আমার নাম ওবামা হলে ১০ সেকেন্ডে নোবেল পেয়ে যেতাম।

ওবামার নোবেল প্রাপ্তি ট্রাম্প মেনে নিতে পারেননি বলে মনে করেন ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেছিলেন, ট্রাম্পের জীবনের প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে গৌরব অর্জন করা। নোবেল শান্তি পুরস্কার তার অর্জনের ঝুলিতে রাখার মতো অসাধারণ একটা সম্মাননা। ওবামা প্রায় কিছু না করেই যেহেতু এটা পেয়েছেন, ট্রাম্প ভাবছেন, আমি এত কিছু করেও কেন পুরস্কারটি পাবো না!

প্রায় একই কথা বলেছেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক টাইলর পেজার। চলতি বছর ২৪ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, নোবেল পুরস্কার নিয়ে জনসম্মুখে হইচইয়ের নেপথ্যে বহুলাংশে কাজ করছে সম্মান, প্রশংসা এবং গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্য ট্রাম্পের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তিনি সবার কাছে প্রমাণ করতে চান, ডোনাল্ড ট্রাম্প শ্রেষ্ঠ মার্কিন প্রেসিডেন্ট।  

ট্রাম্পের নোবেল প্রাপ্তির যৌক্তিকতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাইরের একাধিক ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এ তালিকায় আছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডাগ বারগাম, নিউ ইয়র্কের রাজনীতিবিদ এলিস স্টেফানিকসহ অনেকে।

এছাড়া, আগামী শান্তি পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পের নাম সুপারিশ করেছে পাকিস্তান। দেশটির ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের পরদিনই পাকিস্তান জানায়, (ভারতীয় উপমহাদেশে) আঞ্চলিক অস্থিরতা যখন চূড়ান্ত হয়ে উঠেছিল, তখন নিজের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে ট্রাম্প একটি যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করেছেন।

সম্প্রতি ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করতে ওয়াশিংটন যান পাকিস্তানি ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। ফাইল ছবি: এনডিটিভি

গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ শুরুর চারদিনের মধ্যে তা নিরসন হয়। মার্কিন মধ্যস্থতায় এটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছিল দাবি করে ট্রাম্প বলে আসছেন, তিনি একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছেন।

মার্কিন মধ্যস্থতার দাবি পাকিস্তান মেনে নিলেও ভারত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তান ইস্যুতে তারা কোনও দিন তৃতীয় পক্ষের দ্বারস্থ হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।

এদিকে, পাকিস্তানের দিক থেকে ট্রাম্পের নাম সুপারিশের ঘোষণা আসার কয়েক ঘণ্টা পরই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলার নির্দেশ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লিখেছিলেন, এখন শান্তির সময়।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির উত্তর আমেরিকা প্রতিনিধি অ্যান্থনি যার্চার বলেছেন, ট্রাম্প হয়তো ভাবছেন চাপ প্রয়োগ করে ইরানকে আলোচনার টেবিলে বসানো যাবে।

ট্রাম্পের সমালোচকরা মনে করেন, ট্রাম্প অনেকটা ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করার পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

কালজয়ী উপন্যাস ‘নাইন্টিন এইটি ফোর’-এ প্রচণ্ড কর্তৃত্ববাদী এক রাষ্ট্রব্যবস্থা ফুটিয়ে তুলেছেন জর্জ অরওয়েল। তার গল্পের ক্ষমতাসীনদের খুবই প্রিয় একটি উক্তি ছিল- যুদ্ধই শান্তি (ওয়ার ইজ পিস)। এখন দেখা যাক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই পথেই হাঁটছেন কিনা!