আফ্রিকায় প্রভাব জোরদারে চীনের নতুন কৌশল

আফ্রিকার ওপর চীনের প্রভাব এখনও অটুট রয়েছে। যেখানে অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তির অবস্থান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে সাহেল অঞ্চলের সামরিক সরকারগুলো ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রভাবকে প্রত্যাখ্যান করছে। আর রাশিয়ার ভাড়াটে সামরিক বাহিনীর প্রস্তাব পশ্চিমাপন্থি আফ্রিকার সরকারগুলোর মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। এসব পরিস্থিতির মধ্যে চীন দক্ষতার সঙ্গে একটি মধ্যপন্থা বেছে নিয়েছে, যা তাকে আফ্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে গড়ে তুলেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

এই সপ্তাহে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চীন-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনে (এফওসিএসি) আফ্রিকার ৫০টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসও শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলনে আফ্রিকার বহু নেতাই যোগ দেন, যাদের মধ্যে কঙ্গো-ব্রাজাভিলের দীর্ঘমেয়াদী প্রেসিডেন্ট ডেনিস সাসু-এনগুয়েসো ছিলেন অন্যতম। নতুন সেনেগালিস প্রেসিডেন্ট বাসিরু দিয়োমায়ে ফায়ে, যিনি প্রথমবারের মতো শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেন, তাকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পাশে ফটোসেশনে সম্মানসূচক স্থানে রাখা হয়।

আফ্রিকার সরকারগুলো যারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পক্ষ নিতে চাপের মুখে রয়েছে, তাদের কাছে চীন এখন নির্ভরযোগ্য এবং পক্ষপাতহীন অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মস্কোর মিত্র বা ইউরোপ-আমেরিকার বেসামরিক শাসিত রাষ্ট্রগুলো—চীন উভয়ের সঙ্গেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও বেইজিং নিজ স্বার্থে কঠোরভাবে অর্থনৈতিক চুক্তি করে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য বিনিময়ে ভারী অবকাঠামো নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়, তবুও চীন তার অংশীদারিত্ব ধরে রাখতে সফল হয়েছে।

তবে চীনকে নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। বিশেষ করে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ চীনের ঋণগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন। অনেক দেশ চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের কারণে আর্থিক সংকটে পড়েছে এবং এ কারণে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। চীন তার ঋণ মওকুফ করতে রাজি হয়নি এবং অনেক ক্ষেত্রেই তার কর্মীদের জন্য বিশেষ সুবিধা সংরক্ষণ করেছে, যা আফ্রিকার দেশগুলোর কিছু অংশে অসন্তোষের কারণ হয়েছে। তবে এই ছোটখাটো অভিযোগগুলো অনেক আফ্রিকার সরকারের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না, কারণ তারা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। চীনের পক্ষপাতহীন সহযোগিতা এবং রাজনৈতিক শর্ত ছাড়াই সহায়তা প্রদান তাদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়।

এফওসিএসি সম্মেলনে চীন আরও ৩৬০ বিলিয়ন ইউয়ান (৫০.৭ বিলিয়ন ডলার) বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে, যা আগামী তিন বছরে আফ্রিকার বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হবে। তবে এবারের সম্মেলনে একটি বিশেষ দিক ছিল—পরিবেশবান্ধব (সবুজ) জ্বালানি এবং প্রযুক্তির প্রতি জোর দেওয়া। চীনের লক্ষ্য ছিল আফ্রিকার শিল্পখাতে সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিশেষ করে বৈদ্যুতিক যানবাহন উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ানো। এই পদক্ষেপটি আফ্রিকার শিল্প খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই মহাদেশ এশিয়ার তুলনায় অত্যন্ত পিছিয়ে রয়েছে। চীন এই খাতে বিশেষ করে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি প্রকল্প এবং পারমাণবিক খাতে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

চীনের পারমাণবিক খাতে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। আফ্রিকার দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে ফ্রান্সের সমালোচনা করে আসছে। কারণ ফ্রান্স নাইজার থেকে ইউরেনিয়াম আহরণ করে নিজের পরমাণু শক্তি খাতের জন্য ব্যবহার করেছে। পশ্চিম আফ্রিকার জন্য কোনও প্রকল্প প্রস্তাব করেনি। চীনের এই প্রতিশ্রুতি যদিও আশাব্যঞ্জক, তবুও এর বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন। বিশেষ করে পারমাণবিক খাতে যেসব প্রযুক্তিগত ও নিরাপত্তা সমস্যা রয়েছে, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে চীন কতটা এগিয়ে আসবে, তা এখনও দেখার বিষয়।

যদিও চীনের এফওসিএসি সম্মেলন মূলত সবুজ জ্বালানির দিকে মনোযোগ দিয়েছিল, তবুও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় উপেক্ষিত ছিল। বিশেষ করে আফ্রিকার সমুদ্রসীমায় চীনা জাহাজগুলোর অতিরিক্ত মাছ ধরার অভিযোগ রয়েছে, যা স্থানীয় ক্ষুদ্র জেলেদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করছে। তবে সিয়েরা লিওনের মৎস্য মন্ত্রী প্রিন্সেস ডুগবা কৌশলে এই বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন এবং পরিবর্তে চীনের নির্মিত নতুন একটি মাছ ধরার বন্দর নিয়ে প্রশংসা করেছেন।

শি জিনপিং নিজেকে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর অংশ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন এবং উল্লেখ করেছেন যে, চীন ও আফ্রিকা একসঙ্গে বিশ্বের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের প্রতিনিধিত্ব করে। সম্মেলন শেষে বেইজিং ঘোষণা করেছে যে, চীন-আফ্রিকা সম্পর্ককে নতুন যুগে নিয়ে যেতে একটি ‘ভবিষ্যতের অংশীদারিত্ব’ গড়ে তোলা হবে এবং ২০২৫-২০২৭ সালের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট শি আরও ঘোষণা দিয়েছেন যে, কোভিড পরবর্তী সময়ে অবকাঠামো প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ তিনগুণ বাড়ানো হবে, এক মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে এবং বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়ানো হবে। তবে ৩৬০ বিলিয়ন ইউয়ানের অর্থায়ন কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। এর মধ্যে ২১০ বিলিয়ন ইউয়ান (২৯.৬ বিলিয়ন ডলার) ঋণসুবিধা হিসেবে এবং ৭০ বিলিয়ন ইউয়ান (৯.৯ বিলিয়ন ডলার) ব্যবসায়িক বিনিয়োগ হিসেবে দেওয়া হবে। সামরিক ও খাদ্য সহায়তার জন্য চীন ২৮০ মিলিয়ন ডলার ঘোষণা করেছে, তবে পুরো মহাদেশের জন্য এই পরিমাণ খুবই কম।

চীনের ঋণ নীতি নিয়েও বিতর্ক চলছে। অনেক দেশ দাবি করেছে যে, চীনের ঋণ তাদের অর্থনীতিকে বিপদে ফেলেছে। ২০১৬ সালে চীনের আফ্রিকায় ঋণ প্রদান সর্বোচ্চ ছিল—৩০ বিলিয়ন ডলার। এই ঋণগুলো সাধারণত চীনা এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে গোপন শর্তে প্রদান করা হয়, যা পশ্চিমা দাতা দেশগুলোর থেকে অনেক বেশি খরচ সাপেক্ষ বলে ধারণা করা হয়। তবে চীনের সমর্থকরা যুক্তি দিতে পারেন যে, চীন এমন প্রকল্পে অর্থায়ন করে এবং ঝুঁকি গ্রহণ করে। যেখানে অন্য আন্তর্জাতিক অংশীদাররা সাহস করে না।

চীন আফ্রিকায় বড় ধরনের অবকাঠামো নির্মাণে নেতৃত্ব দিয়েছে, যেখানে পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠী ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো প্রধানত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দক্ষতা প্রশিক্ষণ, খাদ্য নিরাপত্তা, এবং গ্রামীণ পুনরুদ্ধারমূলক প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং মহামারির কারণে আফ্রিকার বহু দেশ নতুন ঋণের বোঝায় জর্জরিত। এ কারণে, জি২০ দেশগুলো চীনের নেতৃত্বে ঋণ পুনর্গঠনের জন্য একটি সাধারণ কাঠামো তৈরি করেছে, তবে সমালোচকরা চীনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

এফওসিএসি সম্মেলন থেকে বোঝা যাচ্ছে, চীনের আফ্রিকায় উপস্থিতি ও কৌশল নতুনভাবে বিকশিত হতে যাচ্ছে। দুই দশক আগে যেমন চীন আফ্রিকার অবকাঠামো উন্নয়নে শূন্যতা পূরণ করেছিল, তেমনি এখন চীন প্রযুক্তি ও সবুজ জ্বালানির ক্ষেত্রে আফ্রিকার প্রধান অংশীদার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, চীনের এই নতুন উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য কতটা বাস্তবায়িত হবে এবং কতটা সফলভাবে এটি আফ্রিকার অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে।