কেনিয়ায় খরা: অনাহার ঠেকাতে বিয়ের নামে ‘বিক্রি’ করা হচ্ছে মেয়েদের

প্রখর রোদে পুড়ছে কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলের কামবিনিয়ে গ্রাম। ৩৪ বছরের দুকানো কেলে সকাল থেকেই পানির সন্ধানে বেরিয়েছেন। সকালের পর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি তার। তবু পাঁচ সন্তানের এই মাকে কাঁটাঝোপের ডাল দিয়ে গাধাকে চাবুক মেরে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে কয়েক কিলোমিটার দূরের বোরহোলে। সেখানেও পানির স্তর নিচে নেমে গেছে—হতাশাই সেখানে তার নিত্যসঙ্গী। 

১৫ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পর থেকে সপ্তাহে দুবার এই কষ্টকর যাত্রা দুকানোর নিয়তি। উত্তর কেনিয়ার এই অঞ্চলের হাজার হাজার নারীর মতো তিনিও প্রতিদিন লড়াই করছেন বেঁচে থাকার জন্য। কালো আগ্নেয় পাথরের ফাঁকে ফাঁকে খড়কুটো দিয়ে বানানো তাঁবু—এটাই তাদের বসত। 

জলবায়ু পরিবর্তন শুধু খরাকে ভয়াবহ ও ঘনঘন করছে না, অদৃশ্য উপায়ে বাড়াচ্ছে বৈষম্যও। এর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব一 হলো বাল্যবিবাহের হার বৃদ্ধি। ৯ মাস ধরে বৃষ্টিহীন এই অঞ্চলে গবাদিপশু মারা যাচ্ছে খাদ্য ও পানির অভাবে। ফলে মরিয়া পরিবারগুলো কন্যাদের বিনিময়ে উট ও ছাগল নিচ্ছে—যা তাদের কয়েক মাসের খাদ্য জোগাবে। 

মারসাবিট শহর থেকে ইথিওপিয়া সীমান্তের দিকে যাওয়ার পথে দুকানোর মতো গল্পের দেখা মেলে প্রায়ই। অনেক মেয়েকে শৈশবেই বিয়ে দেওয়া হয়, তারপর তাদেরই সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হয়। 

খরা আমাদের আরও গরিব করেছে

গ্রাম ছেড়ে প্রায় দুই ঘণ্টা পর দুকানো পৌঁছান কুয়োতে। গাধার পিঠে বাঁধা হলো ছয়টি হলুদ জেরিক্যান। একাকী এক গাছের ছায়ায় অন্যান্য নারীরা অপেক্ষা করছেন। পুরুষরা এই কষ্টকর কাজ থেকে মুক্ত—তারা গ্রামেই রয়ে গেছেন। 

কুয়োর তিন মিটার গভীরে মাত্র ১০ সেন্টিমিটার পানি জমেছে। গ্রামবাসীরা জানান, ঋণ করে ট্রাক দিয়ে এই পানি আনা হয়েছে, যা পরিশোধ করতে তারা ছাগল দিয়েছে—এটাই তাদের একমাত্র মুদ্রা। 

এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর দুকানোর পালা আসে। ধীরে ধীরে রশি দিয়ে পানি তোলেন তিনি, এক ফোঁটা যেন না পড়ে। দুকানো বলেন, গত খরায় আমাদের সব পশু মারা গেছে। সবচেয়ে ছোট ছেলেটি অপুষ্টিতে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম সে মারা যাবে। এখন আবার খরা শুরু হয়েছে, যা আগের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে।

১৪ বছর থেকে ৯ মাস বয়সী তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব দুকানোর। মারসাবিট শহরে যেতে তার কয়েক দিন লাগবে। তিনি বলেন, পানির সমস্যা দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে। আমি ভয় পাচ্ছি সন্তানদের খাওয়াতে পারব কি না। অসুস্থ হলে ওষুধ কিনতে পারব না। আমাদের কোনও টাকা নেই—শুধু ছাগল আর বিনিময় প্রথার ওপর নির্ভর করতে হয়।

আমি একেবারে নিরাপত্তাহীন ছিলাম

স্থানীয় সংস্থা আইরেমোর মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মারসাবিট কাউন্টিতে বাল্যবিবাহের পাশাপাশি ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনাও বেড়েছে। গবাদিপশু চরানোর জন্য নারীদের দূরে যেতে হয়, যেখানে তারা সহিংস পুরুষদের শিকারে পরিণত হয়। 

বুবিসা গ্রামের ওয়াতো গাতো (২০) জানান, ১৫ বছর বয়সে একা পশু চরাতে গিয়ে এক ব্যক্তি তাকে ধর্ষণ করে। তিনি বলেন, ‘আমি চিৎকার করেছিলাম, কিন্তু কেউ শুনতে পায়নি’। কয়েক সপ্তাহ পর তিনি জানতে পারেন অন্ত্বঃসত্ত্বা। পরিবার থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় তাকে। 

প্রধান সড়কের পাশে ফোনের রিচার্জ ও উটের দুধ বিক্রি করে ওয়াতো এখন দুই সন্তানের ভরণপোষণ চালান। আক্রমণকারীর কী হলো? ওয়াতো কাঁধ ঝাঁকান: ‘সে মরুভূমিতে হারিয়ে গেছে। আমার তাকে অভিযুক্ত করার কোনও উপায় ছিল না।’

বেছে নেওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না

অক্সফামের অ্যাডভোকেসি উপদেষ্টা এলিস নালব্যান্ডিয়ান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে কেনিয়ার এই শুষ্ক অঞ্চলের নারী ও কিশোরীদের ওপর।

১৫ বছর বয়সে বোক মোল্লুকে বিয়ে দেওয়া হয় এক অচেনা মানুষের সঙ্গে। বিনিময়  মূল্য ছিল তিনটি উট ও তিনটি ছাগল। ১৯ বছরের বোক বলেন, আমি অবশ্যই বাবা-মাকে দোষ দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানি, খরা এত ভয়াবহ না হলে তারা এটা করত না। তাদের জন্য বেছে নেওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না।

বিয়ের পর স্বামী তার ওপর নির্যাতন শুরু করে। বোক বলেন, তিনি আমাকে অনেকবার ধর্ষণ করেছেন। তবু আমি থাকতাম—আমার আর কী করার ছিল? আমার পরিবার আমাকে ফিরে নিত না, কারণ স্বামী দেনমোহর দিয়েছিলেন। 

বোকের গল্পের পেছনে আছে ৪০ বছরের ভয়াবহ খরা। কামবিনিয়ে গ্রামের বাইরে পশুর হাড়ের স্তূপ তারই সাক্ষী। প্রতিটি খুলি সেই সব উট, গরু ও ছাগলের, যেগুলো একদিন এই অঞ্চলের মানুষের জীবিকার উৎস ছিল।

সূত্র: আল জাজিরা