স্বামীর বিরুদ্ধে কানাডার আদালতে নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছেন আফগানিস্তানে অপহৃত হওয়ার পর উদ্ধার পাওয়া এক নারী। তালেবান সমর্থিত একটি গ্রুপের হাতে পাঁচ বছরের বন্দি জীবনের আগে-পরে ছাড়াও বন্দি থাকাকালীন নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন কাইতলান কোলম্যান (৩৩) নামের ওই নারী। তার স্বামী জসুয়া বোয়েল (৩৫) এখন যৌন নিপীড়ন, বেআইনি বন্দিদশা এবং হত্যার হুমকি দেওয়াসহ ১৯ ধরণের নিপীড়নের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন।
২০১১ সালে গর্ভবতী অবস্থায় আফগানিস্তানে তালেবান সমর্থিত গ্রুপ হাক্কানি নেটওয়ার্কের হাতে স্বামীর সঙ্গে অপহরণের শিকার হন কাইতলান কোলম্যান নামের ওই নারী। পাঁচ বছরের বন্দিদশার পর তিন সন্তানসহ এই দম্পত্তিকে উদ্ধার করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ওই সময়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে পরিণত হন তারা।
শুক্রবার দ্বিতীয় দিনের মতো কানাডার আদালতে স্বামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন কাইতলান কোলম্যান। এদিন আদালতে স্বামীর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আফগানিস্তানে বন্দিদশায় বোয়েল তার জীবনের সবক্ষেত্রেই হুকুমদারি করতেন। তার আচরণ অনেকটা ছিল অপহরণকারীদের মতোই। আদালতে কোলম্যান বলেন, আমি কখনওই তার সঙ্গে কোনওকিছু নিয়ে দ্বিমত পোষণ করিনি, এমনকি ছোটখাটো কোনও বিষয়েও নয়। অতীতে সে এটা পরিস্কার করে দিয়েছিল আমাকে আঘাত করে সে কোনও ধরণের অনুতাপ ভোগ করে না।
সাদা ব্লেজার, কালো পোশাক ও কালো হেডস্কার্ফ পরিহিত কোলম্যান বোয়েলের মুখোমুখি হওয়া এড়াতে আদালতে পাশের একটি কক্ষ থেকে ভিডিও কনফারেন্সে বিচারকের সঙ্গে কথা বলেন। আদালতে সাক্ষ্য দিতে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া থেকে কানাডা আসেন কোলম্যান। বর্তমানে সেখানেই পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন তিনি।
অপরদিকে নেভি ব্লেজার ও মেরুন প্যান্ট পরিহিত বোয়েল আদালত কক্ষে সামনের সারিতে বসে ছিলেন। হলুদ রঙয়ের আইনি নোটবুকে অনবরত নোট নিচ্ছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন তার বাবা-মা।
আফগানিস্তানের বন্দিদশা থেকে কানাডায় ফিরে আসার পর বোয়েল-এর নিপীড়ক আচরণের বর্ণণা দেন কোলম্যান। তিনি বলেন, বোয়েল মিলিত হতে চাইলে তা প্রত্যাখান করলে মারধরের শিকার হতেন। গত ২৭ নভেম্বরের ঘটনায় তিনি খুবই ভীত হয়ে পড়েন বলে আদালতে দাবি করেন। কোলম্যান দাবি করেন, সেদিন বোয়েল তাকে বিছানায় যেতে বলে ব্যাগে থাকা দড়ি নিয়ে আসে...আর তারপরে হাত-পা বাধা শুরু করে। বোয়েল যৌন নিপীড়ন চালানোর পর তার বাধন খুলে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কোলম্যান বলেন, ‘সে আমাকে বলে যে আমাকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না, সুতরাং সেকারণে আমার বাধন খুলে দেবে না।’ বোয়েল ঘুমিয়ে পড়লে নিজে নিজে সেই খোলেন বলে দাবি করেন তিনি। বলেন, পেছনে তাকিয়ে আমি পালানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি।
আদালতে দেওয়া আগে সাক্ষ্যে কোলম্যান বলেছিলেন, বোয়েলের সঙ্গে তার সম্পর্ক যে যেন ‘রোলারকোস্টারের’ গতিতে ছুটেছে। অনলাইনের একটি চ্যাটরুমে ১৬ বছর বয়সে বোয়েলের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। বুধবার আদালতে তিনি বলেছিলেন, ‘জীবনে প্রথমবার তাকেই চুমু খেয়েছিলাম’। কোলম্যানের দাবি অনুযায়ী খুব দ্রুত তিনি বোয়েলের প্রেমে পড়েন। আদালতে তিনি বলেন, তবে শিগগিরই সে শারিরীক এবং মানসিকভাবে এক নিপীড়ন সঙ্গীতে পরিণত হয়। অন্য পুরুষের আলাপচারিতা বা পান করলেই ক্ষেপে যেত সে। কোলম্যান দাবি করেন, ঠাট্টার ছলে তাকে আগুনে বা গরম তেলে পুড়িয়ে মারার হুমকি দিতো। এটা সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারতম অধ্যায়।
আফগানিস্তানে পাঁচ বছরের বন্দিদশার সময়ে অন্তত ২০ বার এই দম্পত্তির স্থান পরিবর্তন করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। আদালতে আগেও বলা হয়েছে আফগানিস্তান থেকে কানাডায় ফেরার পরও বোয়েলের নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। কোলম্যান সাক্ষ্যে বলেছেন, প্রায়ই মারধরের পর বোয়েল মিলিত হতে চাইতেন, একবার তাকে শক্তিশালী ঘুমের ওষুধও খাওয়ানো হয়। বুধবার আদালতে তিনি বলেন, সে বাথরুমে দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে ওই ওষুধ খেতে বাধ্য করে...আমি ওষুধটি নিয়েছিলাম কারণ আমি জানতাম যদি না নেই তাহলে আমাকে মার খেতে হবে।
শুক্রবার কোলম্যান আদালতে বলেন, অটোয়ায় ফিরে আসার পর বোয়েল তার খাদ্যাভ্যাস, ওজন, আচরণ এবং মিলনের ধারাবাহিকতা নিয়ন্ত্রণ করতে নিয়মের একটি তালিকা ধরিয়ে দেয়। ওই নিয়ম মানা না হলে আমাকে শাস্তি পেতে হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, নিয়মের ব্যত্যয় হলে খাবার কেড়ে নেওয়াসহ শারিরীক শাস্তি ভোগ করতে হতো। কোলম্যান আদালতে বলেন, ওই নিয়মের মধ্যে ছিল তার সন্তানদের স্যার বা ম্যাডাম বলে সম্মোধন করা। যাতে আমি বুঝতে পারি যে আমি সবার চেয়ে নিচে অবস্থান করি।
কোলম্যান আদালতের সাক্ষাৎকারে বলেন, এক সময়ের উচ্চাভিলাষী সাংবাদিক বোয়েল আফগানিস্তানে বন্দিদশায় থাকার সময়ের বর্ণনাও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, ‘কী বলতে হবে সে বিষয়ে মৌখিক ও শারিরীক নির্দেশনা দিয়ে রাখতো বোয়েল। সে বলে দিতো কোন গল্পটি বলতে হবে বা বন্দিদশার কোন অংশটি নিয়ে কথা বলতে হবে।
বোয়েলের বিরুদ্ধে মোট ১৯টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টির শিকার হয়েছে কোলম্যান। বাকি দুটি অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তির নাম প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, আট সপ্তাহ ধরে এই বিচার চলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।