যেভাবে ‘জিকা’ চিনলেন ব্রাজিলের ডাক্তাররা

nonameইবোলার পর দুনিয়াজুড়ে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক তৈরিকারী ভাইরাসটির নাম জিকা। ব্রাজিলেই এর প্রকোপ সবথেকে বেশি। সেই ব্রাজিলের ডাক্তাররা এই ভাইসরাটি নিয়ে এতোদিন কী কী অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন, তা নিয়েই একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস। প্রকাশিত প্রতিবেদনে জিকা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে তা শনাক্ত করতে চিকিৎসকদের যে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তা তুলে ধরা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনের নির্বাচিত অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-
মাইক্রোসেফালিতে জন্ম নেওয়া প্রথম শিশু
গত বছর আগস্টে আটলান্টিকের নিকটবর্তী রেসিফ শহরে প্রথম মাইক্রোসেফালিতে আক্রান্ত শিশুর জন্ম হয়। চিকিৎসকরা তখন খুবই অবাক হয়েছিলেন। শিশুটির অবস্থা সম্পর্কে ব্রাজিলের সংক্রমণ রোগের প্রতিষ্ঠানের গবেষক ড. সেলিনা এম. টুর্চি জানান, চিকিৎসক, শিশু বিশেষজ্ঞ, নিউরোলজিস্ট কেউই আগে এমন বাস্তবতার মুখোমুখি হননি। সেলিনা বলেন, স্বাভাবিক মুখ ও ভ্রু আছে কিন্তু কপাল না থাকায় শিশুটির মাথা খুব অদ্ভুত লাগছিল। তখনও আমরা জানতাম না এই অবস্থাকে মাইক্রোসেফালি বলে। দেখতে ভয়ঙ্কর লাগলেও শিশুর স্বাস্থ্য ছিল স্বাভাবিক। শিশুটি স্বাভাবিকভাবেই খাবার গ্রহণ করতো, কাঁদত। মনেই হতো না অসুস্থ।’

যেভাবে শনাক্ত হয় লক্ষণ

প্রথম মাইক্রোসেফালিতে আক্রান্ত শিশুর জন্মের এক বছর আগের কথা। রেসিফে থেকে দুইশ মাইল দূরে রিও গ্রানডে ডো নর্টে রাজ্যের নাটালের একটি সরকারি হাসপাতালে একজন রোগী পাওয়া যায়, যার চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরতে থাকে। ব্রাজিলে ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল শেষ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর এ ঘটনা ধরা পড়ে। এরপর এ ধরনের আরও বেশ কিছু রোগী শনাক্ত হন। যাদের বেশিরভাগই ব্রাজিলের দরিদ্র এলাকায় বাস করেন। সবারই লক্ষণ ছিল প্রায় একই রকম। রক্তবর্ণের চোখ, জ্বর, মাথা ব্যাথা, হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা ও বড় আকারে রাশ ওঠা ছিল অন্যতম লক্ষণ। তবে কোনও রোগীর অসুস্থতা মারাত্মক ছিল না।

noname

ওই সময়কার অবস্থার কথা জানালেন এক সেবিকা। অ্যালিন বেজেরা নামের ওই সেবিকা জানান, তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন কিছু রোগী, চিকিৎসক আর তাদের টিম। বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। হালকা ধরনের ডেঙ্গু জ্বরের কথা ভেবেছিলেন তারা। তিনি জানান, অন্যান্য ভাইরাসের মতোই এটিও পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু রোগীর সংখ্যা বাড়তেই থাকল। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের একদিনেই সরকারি হাসপাতালে ১০০ রোগী আসেন।

এরপর টনক নড়ে চিকিৎসক ও গবেষকদের। ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অব রিও গ্রানডে ডো নর্টের সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ক্লেবার লুজ তখন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, তারা এমন গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি কিছু মোকাবেলা করছেন যা আগে কখনও দেখা যায়নি। আর মার্চ মাসে ‘অজ্ঞাত’ এই রোগটি এমন ছড়িয়ে পড়ে যে, কর্তৃপক্ষের পক্ষে আর অগ্রাহ্য করা সম্ভব ছিল না। ততোদিনে নিকটবর্তী আরও দুই রাজ্যে একই ধরনের রোগী পাওয়া যায়। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে ২৫ লাখ মানুষের সালভাদর শহরে।

যেভাবে চেনা গেল জিকাভাইরাস

যখন অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, চিকিৎসকরা ধারণা করছিলেন এটা ছিল কোনও ধরনের অ্যালার্জি। আবার কোনও কোনও চিকিৎসক ভেবেছিলেন মুখে দাগ ওঠার মতো শিশুকালীন রোগ। তবেমোটামুটি সবাই এটাকেই রোজিওলা রোগের কোনও পর্যায় বলে ভেবেছিলেন।

এই রোগের নেপথ্যে মশার ভূমিকা থাকতে পারে তা প্রথম ধারণা করেন সালভাদরের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাহিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট ড. গুবিয়ো সোয়ারেজ। তিনি বলেন, লোকজন মনে করছিল রোগটি পানির মধ্য দিয়ে সংক্রমিত হচ্ছে। আমি তখন থেকেই ধারণা করতে শুরু করি রোগটি মশা দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছিল। এরপর শুরু হয় রোগীদের রক্তের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা। ড. সুয়ারেজ ও ড. সিলভিয়া সার্দি একের পর এক নমুনা পরীক্ষা করতে থাকেন।

noname

দেশের অন্য চিকিৎসকরাও একইভাবে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করছিলেন। প্রায় ৬ হাজার ৮০০ নমুনা পরীক্ষা করেন দেশটির চিকিৎসকরা। ৪ মাস থেকে ৯৮ বছরের রোগী ছিলেন এর মধ্যে। পার্বোভাইরাস, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ বেশ কিছু রোগ ধরা পড়ে।

অবশেষে ড. সুয়ারেজ ও ড. সার্দি নিশ্চিত হন, এই রোগের কারণ ছিল জিকা ভাইরাস। নিশ্চিত হওয়ার পর ড. সুয়ারেজ বলেন, ‘আমি তখন হাফ ছেড়ে বাঁচার মতোই অনুভূতি পাই। তবে আগে জানতাম ব্রাজিলে যে ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ আছে, জিকা সেগুলোর চেয়ে কম ক্ষতিকর।’

ওই সময় দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. আর্থার কিওরিও তাই ভেবেছিলেন। মে মাসে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জিকা ভাইরাস নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন নই। তবে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর ইনফেকসিয়াস ডিজিস নামক একটি সংস্থা।  তারা বলেছিল, ব্রাজিলে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ খুব একটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা নয়।

যেভাবে ব্রাজিলে জিকা ভাইরাসের আগমণ

২০১৪ সালের মে মাসে ব্রাজিলে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। দেশটির সবগুলো শহরে জিকায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। কিভাবে ব্রাজিলে জিকা ভাইরাসের আগমণ ঘটলো তা নিয়ে দুই ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

প্রথম মত হলো, ব্রাজিলের বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ২০১৪ সালে ফুটবল বিশ্বকাপের সময়েই ভাইরাসটি আসে। ওই সময় বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ দেশটিতে আসেন। নাটাল শহরে যদি প্রথম রোগী পাওয়া যায় তাহলে এই মতের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।

দ্বিতীয় মত দিচ্ছেন ফরাসি বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে পলিনেসিয়াতে জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কয়েক সপ্তাহ পরেই ব্রাজিলে এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। রিও ডি জেনিরোতো একটি রেস প্রতিযোগিতায় পলিনেসিয়ার দ্বীপের অনেক মানুষ আসেন। ওই সময়েই তাদের মাধ্যমে ব্রাজিলে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে।

আশঙ্কার শুরু

মে মাসে জিকা ভাইরাস শনাক্ত হলেও ব্রাজিল বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব সহকারে নেয়নি। কিন্তু কয়েক মাস পর অক্টোবরে এসেই দেশটি বুঝতে পারে তাদের আগের ধারণায় ভুল ছিল। ওই সময় বেশ কিছু শিশু মাইক্রোসেফালিতে আক্রান্ত হয়ে জন্ম নেয়। আগের বছরে যেখানে এ সংখ্যা ছিল ১৪ জন, ২০১৫ সালে তা দাঁড়ায় ৫০ জনে।

তখন চিকিৎসকরা বুঝতে শুরু করেন, ভয়াবহ কিছু একটা ঘটছে। চিকিৎসকদের অনেকেই জানতে পারেন ওইসব শিশুদের জন্ম দেওয়া মায়েদের অনেকেই জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু মায়েদের রক্ত পরীক্ষায় তখন জিকার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। কারণ ততোদিনে তারা সুস্থ হয়ে ওঠেছেন। অক্টোবরের শুরুতে ড. টুর্চিকে বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে দায়িত্ব দেয় দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়। আশঙ্কা বাড়লেও তখনও চিকিৎসকরা মাইক্রোসেফালি রোগ চিহ্নিত করতে পারেননি।

noname

উদ্বিগ্ন মায়েরা

অজ্ঞাত রোগে বিকৃত মস্তিষ্ক নিয়ে শিশু জন্মের ঘটনায় উদ্বিগ্ন ও আতংকিত হওয়া শুরু করেন ব্রাজিলের মায়েরা। বেশির ভাগ মায়েরাই ছিলেন বয়সে তরুণ। গ্রাম থেকে আসা অনেক মা কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না, কেন তাদের শিশু এমন হলো। বাড়ছিল হতাশা। চিকিৎসকরাও কোনও সুনির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারছিলেন না। এক মা জানান, বিষয়টি ছিল তার জন্য অনেক বড় আঘাত ও খুব কষ্টের। আরেক মা জানান, তিনি কয়েক সপ্তাহ ধরে ঘুমাতে পারেননি। ড. টুর্চি জানান, মাইক্রোসেফালির সঙ্গে জিকা ভাইরাসের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া খুব সহজ ছিল না।

মাইক্রোসেফালির নেপথ্যে জিকা ভাইরাস

অজ্ঞাত রোগের কারণ অনুসন্ধানে ড. টুর্চি তার পরিচিত বিশ্বের বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নভেম্বরে জিকা ভাইরাসের সঙ্গে মাইক্রোসেফালি রোগের যোগসূত্র সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা তৈরি হয়।

প্যান আমেরিকান স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় অবশেষে ড. টুর্চি এ যোগসূত্র আবিষ্কার করেন। জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত ১ হাজার গর্ভবর্তী নারীর কাছ থেকে তারা নমুনা সংগ্রহ করেন। এসব নারীদের নমুনা পরীক্ষা করে তারা নিশ্চিত হন যে, জিকা ভাইরাসের কারণেই শিশুরা মাইক্রোসেফালিতে আক্রান্ত হচ্ছে। ড. টুর্চি বলেন, ‘আমি এখন অনেক আশাবাদী। আন্তর্জাতিক উদ্বেগ লক্ষ্য করার মতো। অনেক মানুষ একটি টিম আকারে কাজ করছে।’ সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস

/বিএ/