ভূমি ও খনিজসম্পদ দখল নিতেই রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ?

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দেশটির প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর চলমান তথাকথিত ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের নৃশংসতা ও সহিংসতাকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা আখ্যায়িত করেছে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত খবরে রোহিঙ্গা সংকটের নেপথ্যের কারণ হিসেবে ধর্মীয় ও জাতিগত সংঘাতের বিষয়টিই আলোচিত হচ্ছে। খুব কম প্রতিবেদনেই রোহিঙ্গা সংকটের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তবে অল্প কয়েকজন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও লেখক এই সংকটের কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক কারণ, বিশেষ করে মিয়ানমারজুড়ে ভূমি দখল ও উচ্ছেদের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন।

রাখাইনে চীনের পাইপলাইন

কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও ‘এক্সপালসন্স: ব্রুটালিটি অ্যান্ড কমপ্লেক্সিটি ইন দ্য গ্লোবাল ইকনোমি’ বইয়ের লেখক সাসকিয়া সাসেন হাফিংটন পোস্টে এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ধর্ম ও জাতিসত্ত্বার বিষয়টি রোহিঙ্গাদের নিপীড়নে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংবাদের কেন্দ্রে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিপীড়ন  দীর্ঘ ও নিষ্ঠুর ইতিহাসের অংশ। কিন্তু  শুধু ধর্মীয় ও জাতিগোষ্ঠীর বিষয়টি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলমান এই সহিংসতার ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধতা থেকে যাচ্ছে।

সাসকিয়া সাসেনের মতে, ২০১৬ সালে রাখাইনের গ্রামীণ অঞ্চলের ৩০ লাখ একর জমি ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নে’র জন্য জাতীয়করণের একটি সিদ্ধান্ত মিয়ানমার সরকার। সরকারি নথি অনুযায়ী, এই সিদ্ধান্তের আগেই ২০১২ সালে ১৭ হাজার একর ভূমি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়।  সু চি’র ডি ফ্যাক্টো সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই গত ২০ বছর ধরে বার্মিজ নাগরিক ও বিদেশি কোম্পানির কাছে এসব ভূমি বিক্রি হচ্ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত রাখাইনে মিয়ানমার সরকারের নজর খুব বেশি ছিল না।

এর কারণ হিসেবে সাসকিয়া উল্লেখ করেছেন রাখাইনে চীনের অর্থায়নে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা। রাখাইনের উপকূলে গভীর সমুদ্র বন্দর, তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন এবং শিল্পাঞ্চলের জন্য চীনা কোম্পানি বিপুল বিনিয়োগ করছে। এর ফলে রাখাইনের ভূমি নিয়ে দেশটির সেনাবাহিনীর আগ্রহ বেড়েছে। আর এসব জমি খালি করার জন্য ধর্মীয় ও জাতিগোষ্ঠীর বিষয়টিকে সামনে এনে সহিংসতা তৈরি করে সবার চোখে ধূলো দেওয়া হচ্ছে।

রোহিঙ্গা সংকটের কারণ হিসেবে বড় ধরনের সরকারি ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি সামনে এনেছেন সাসকিয়া। তিনি বলছেন, এ ক্ষেত্রে চীনের বৈশ্বিক ও কৌশলগত স্বার্থ জড়িত। এর পাশাপাশি স্থানীয়ভাবেও ব্যাপক আকারে ভূমি দখল ও উচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল মিয়ানমার টাইমস এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সেনাবাহিনীর দখল করা ভূমি থেকে লাভবান হচ্ছে হিলটন ও ম্যাক্স হোটেলের মতো বিলাসবহুল হোটেল। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাখাইনে ১৯৯৬ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ৫৫নং ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের দখল করা ৩৫.৫ একর কৃষি জমির ওপর চারটি বিলাসবহুল হোটেল গড়ে উঠেছে। ওই ভূমির মূল্য কোটি টাকার বেশি। অথচ জমির মালিকদের নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর দাবি, উপকূলের নিরাপত্তার স্বার্থে এসব ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

রাখাইনে চীনের বিনিয়োগে গভীর সমুদ্র বন্দর

চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার সংবাদমাধ্যমে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। ওই খবরে বলা হয়েছে, রাখাইনে রাজধানীতে বড় ধরনের ভূমি দখলের ঘটনায় সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হওয়ার কথা। এই তদন্তে ১৪৩ একর ভূমি দখল করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রাখাইনে ভূমি দখলের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব না থাকায় তারা কোনও মামলাও করতে পারেন না, জমির মালিকানাও দাবি করতে পারেন না। ফলে ভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদের ঘটনাগুলো সংবাদমাধ্যমেও আসে না।

মিয়ানমারে ভূমি দখলের ঘটনা শুধু রাখাইনে ঘটছে, এমন নয়। দেশটির কাচিন ও শান প্রদেশেও বড় ধরনের ভূমি অধিগ্রহণ ও দখলের ঘটনা ঘটেছে। আর কাচিন ও শান প্রদেশের খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছে সেখানকার জাতিগোষ্ঠীগুলো।

অন্য এক প্রবন্ধে সাসকিয়া সাসেন লিখেছেন, গ্রামীণ এলাকার আক্রান্তদের প্রবণতা পর্যালোচনা করলে দু’টি প্রধান বিষয় বেরিয়ে আসে। প্রথমত, পরিমাণে কম হলেও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরাও গত কয়েক বছরে নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বড় আকারের বৃক্ষ নিধন, খনি ও পানির প্রকল্পের কারণে মানুষকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।

সাসকিয়া আরও লিখেছেন, সু চি ক্ষমতায় আসার পর সেনাবাহিনীর ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে পদক্ষেপের আশা করেছিলেন অনেকে। কিন্তু বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়। ২০১২ সালে মিয়ানমারকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত হয়। ওই বছরের ৩০ মার্চ দেশটির সংসদের উচ্চ ও নিম্নকক্ষে কৃষি জমি ও পতিত ভূমি নামে দু’টি ভূমি আইন সংশোধন করা হয়। এছাড়া সরাসরি শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগের আইনও পাস হয়। এই আইনে বলা হয়, বিদেশি কোম্পানিগুলো খনি ও কৃষিখাতে কাজ করতে ৭০ বছরের জন্য ভূমি লিজ নিতে পারবে।

রাখাইনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ গ্যাস ক্ষেত্র (লাল দাগ চিহ্নিত)

দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের গবেষক ব্রায়ান ম্যাককার্টান ২০১৩ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয় ৭ লাখ ৮ হাজার ২শ হেক্টর কৃষিজমি ২১৬টি কোম্পানিকে দিয়েছে। এসব জমির বেশিরভাগই কাচিন, শান, কারেন ও মুন রাজ্যে। বেশিরভাগ জমিই সেনাবাহিনী দখল করে বিভিন্ন কোম্পানিকে দিয়েছে। এক্ষেত্রে দেশটির সেনাবাহিনী পরিচালিত দু’টি কোম্পানিই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে।

স্পুটনিকের এক প্রতিবেদনে রুশ বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা সংকটের পেছনে অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয়— দুই ধরনের কারণই রয়েছে। বড় বড় ভূ-রাজনৈতিক ক্রীড়ানকরা এর সঙ্গে জড়িত বলে মনে করেন তারা। ওই বিশ্লেষকদের মতে, সংকটের মূলে রয়েছে মিয়ানমারের মাটির নিচে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদ।

সেন্টার অন হাউজিং রাইটস অ্যান্ড এভিকশন্সের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৩ সালে দক্ষিণ কোরীয় একটি কোম্পানি রাখাইন উপকূলে শেইয়ি নামের একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। এই ক্ষেত্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বড় গ্যাসক্ষেত্র বলে মনে করা হয়। এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২০০৬ সালে পেট্রো চায়না কোম্পানির সঙ্গে ৬.৫ ট্রিলিয়ন কিউবিক গ্যাস নেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে।

প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, গ্যাসক্ষেত্রটির কারণে গত দুই দশকে আরাকান ও শান রাজ্যে সামরিক উপস্থিতি বেড়েছে। পরে ২০০৭ সালের জুলাই মাসে থাইল্যান্ডের একটি কোম্পানি আরেকটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই গ্যাসক্ষেত্রে ৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রয়েছে।

কান্ট্রি রিস্ক সল্যুশনসের প্রতিষ্ঠাতা ও ভার্চুয়াল টেরর বইয়ের লেখক ড্যানিয়েল ওয়াগনারও বলছেন, রাখাইনের তেল ও গ্যাসের কারণেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে দিয়ে বিদেশি শক্তিগুলো রোহিঙ্গাদের উৎখাত করাচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণ এটিই।

ড্যানিয়েল জানান, রাখাইনে শুধু চীন ও ভারতের স্বার্থ নয়, রয়েছে অনেক বিদেশি স্বার্থও। সৌদি আরব রাখাইনের খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও বিতরণে চীন ও মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত রাখাইন রাজ্যে সড়ক ও হোটেল নির্মাণ করছে তেল বাণিজ্য বাড়াতে। আর মিয়ানমার হয়ে চীনে মিথেন রফতানি করছে কাতার।

এসব সম্পর্কের জের ধরেই ড্যানিয়েল মনে করেন, এই পরিস্থিতির কারণে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের একেবারে উৎখাত না করা পর্যন্ত থামবে না মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

ভূমি দখলের প্রতিবাদে রাখাইনের রাজধানীতে স্থানীয়দের বিক্ষোভ

মিয়ানমারে বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও দেশটির গুরুত্বপূর্ণ খাত ও মন্ত্রণালয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করছে সেনাবাহিনীই। আর সেনাবাহিনীর প্রভাব ও ক্ষমতার কাছে অসহায় দেশটির ডি ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চি। ফলে মিয়ানমার রোহিঙ্গা সমস্যার চেয়ে আরও গভীর সংকটের দিকে পতিত হচ্ছে বলে মনে করেন হংকং-অ্যাপেক ট্রেড পলিসি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ডেভিড ডডওয়েল। তিনি মনে করেন, সু চি বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছেন। দেশটির সর্বময় ক্ষমতাশালী সেনাবাহিনীর ওপর তার সীমিত প্রভাবের কারণেই এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। তার পক্ষে সেনাবাহিনীকে থামানো ও তাদের স্বার্থের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ানো অসম্ভব।

ভূ-রাজনীতি আর অর্থনীতি নিয়ে বিশ্লেষকদের মন্তব্যের প্রতিফলন চলমান রোহিঙ্গা সংকটেও স্পষ্ট। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে নিন্দা ও উদ্বেগ জানানো হলেও মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক-আর্থিক সংকটে সম্পর্কিত চীন-ভারতের মতো দেশগুলো রোহিঙ্গা সংকটে খুব বেশি উচ্চকিত নয়। তাদের এই নিরবতা হয়তো তাদের ভূ-রাজনেতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ সংরক্ষণেরই কৌশল।