‘দুঃখিত, আপাতত স্বপ্ন দেখবেন না’ এমনটাই বলছে তালেবান হটলাইন?

ধরা যাক নাম তার গনি। থাকেন কাবুলেরই আশপাশে। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর জীবনের প্রতি গনি সাহেবের বিতৃষ্ণা এখন চরমে। তাকে এখন সারাক্ষণ বেগমের সঙ্গে উঠতে বসতে হয়। বেগম ঘুরতে যাক আর শপিংয়ে যাক, সঙ্গে তাকেও যেতে হবে। না গেলে তালেবানরা বলে দেয়, যান, স্বামীকে নিয়ে আসুন। স্বামী ছাড়া হাঁটা নিষেধ।

আজও একজোড়া কানের দুল কিনতে স্ত্রীর সঙ্গে মার্কেটে এক ঘণ্টা ঘুর ঘুর করতে হয়েছে গনি সাহেবকে। বোরখার নিচে দুল কে দেখবে? বেগমের মাথাব্যথা নেই। বেগম আশা নিয়ে বসে আছেন, কোনও একদিন হাট-বাজার, কমিউনিটি সেন্টার বা ঘটা করে বিয়েশাদি চালু হলে তিনি ওই দুল পরবেন।

তো এসব নিয়ে গনি সাহেব এতটাই হতাশ যে তিনি আত্মহত্যা করবেন ঠিক করেছেন। হাঁটছিলেন রাস্তা ধরে। হঠাৎ চোখে পড়লো একটা সাইনবোর্ড-‘সুইসাইড করার কথা ভাবছেন? আগে অন্তত একবার ফোন করুন, হটলাইন-০০০০।’

আরে! দেশটা কাতার হয়ে গেলো নাকি! অবাক হলেন গনি। আফগানিস্তানের মতো দেশে সুইসাইড হটলাইন! এমন হটলাইন সম্পর্কে টুকটাক শুনেছেন গনি সাহেব। হটলাইনে ফোন করে সুইসাইডের কথা বললেই ওপর প্রান্তের লোকটা মিষ্টিমধুর স্বরে তাকে নানাভাবে জীবনের মাহাত্ম্য বোঝাবে। বলবে, ভাই সুইসাইড করবেন না। দেখুন, বেঁচে থাকা কত সুন্দর।

সুইসাইড করার আগে এমন একটা সার্ভিস দেখে সেখানে ফোন করার লোভ সামলাতে পারলেন না গনি সাহেব।

‘হ্যালো, আফগান সুইসাইড হটলাইন?’

অপরপ্রান্তে ফ্যাঁসফ্যাঁসে একটা গলা শুনতে পেলেন-‘কী চাই!’

‘জ্বি আজ্ঞে, আমি সুইসাইড করবো ঠিক করেছি।’

অপরপ্রান্তে খানিক নীরবতা। তারপর খসখসে গলায় লোকটা জানতে চাইলো, ‘ড্রাইভিং জানা আছে?’

 

আফগান নারীদের দশা কি এখন গনি সাহেবের মতো। তাদেরকে বলা হলো আশা দেখুন, বাইরে আসুন, কাজে যোগ দিন। সরাসরি না বলেও ইনিয়ে বিনিয়ে কয়েকজন বললেন, তালেবান বদলে গেছে। সব আগের মতো চলবে, নারীরা স্বাধীনতা পাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব শুনে জাতিসংঘও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খাদ্য সহায়তা নিয়ে পাঠানোর চিন্তা করছে তাদের কর্মীদের। কিন্তু গর্ভে আট মাসের শিশুসহ বানু নিগারকে তো মরতেই হলো। তার রক্তে রঞ্জিত দেয়ালের ছবি পরিবারের লোকজন তুলে ঠিকই দিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে (যদিও তা ছাপা হয়নি, সূত্র: বিবিসি)। তালেবান হটলাইন বললো, তারা বানুকে মারেনি। তবে আগের সরকারের পুলিশে কাজ করা আটমাসে গর্ভবতী বানুর ওপর কার এমন ক্ষোভ থাকবে?

কাবুলে সম্ভবত এখন স্বপ্ন দেখাতেও নিষেধাজ্ঞা আছে। শিল্প-সংস্কৃতিতে জড়িত থাকছেন কি মরেছেন। আফগান শিল্প ও শিল্পমনাদের সংগঠন আর্ট লর্ডস দেশটিতে অনেকগুলো স্বপ্ন জাগানিয়া ম্যুরাল বানিয়েছিল। দেশের ধ্বংসস্তূপ সরানো বা কৃষি-কারখানার কাজ বাদ দিয়ে তালেবানরা এখন রঙের বালতি হাতে রাস্তায় নেমেছে ওসব শিল্পকর্ম মুছতে। আরেক গ্রুপ, যারা বানু নিগারকে হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি, তারা ব্যস্ত দেশটির রাস্তায় নামা নারীদের মাথা ফাটাতে।

কাবুলের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামনে গত শনিবার (৪ সেপ্টেম্বর) বিক্ষোভ করতে গিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন আফগান নারী। সরকারে তাদের অংশগ্রহণের দাবি জানিয়েছিলেন তারা। নিজেরা নিজেদের মাঝে বেশ ‘নিরাপদেই’ ছিলেন। কিন্তু অনিরাপত্তার কারণ হয়ে দাঁড়ালো তালেবানরাই।

আন্দোলনের অংশ নেওয়া রাজিয়া বারাকযাই আল-জাজিরাকে জানিয়েছেন, ‘একসময়  চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলে তালেবানরা। তাদের বলায় হয় একজন একজন করে বেরিয়ে যাও। কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড, তারাই আমাদের বের হতে দিচ্ছিল না। এমনকি আমাদের ঘিরে রেখে পেপার স্প্রে ও টিয়ার গ্যাসও ছোড়ে ওরা।’

সেই হিসেবে অবশ্য কাবুল সত্যিই নারীদের জন্য নিরাপদ নয়। তালেবান নয়, এমন পুরুষের ‘নিরাপত্তা’ ছাড়া তাদের বের হলেই বিপদে পড়তে হবে। কারণ পথেঘাটে এখন হাক্কানি জোশে বুলেটের মালা পরে বসে আছে তালেবানরা (যদিও বাইরের কোনও সেনা এখন দেশটিতে নেই)।

রাজিয়াদের থামিয়ে দিতে তালেবান এতই মরিয়া ছিল যে তারা তাদের ওপর হামলাও চালায়। রাজিয়া জানালেন, একটা মেয়ের মাথা ফেটে রক্তও পড়ছিল। সেই ছবিও কিন্তু স্যোশাল মিডিয়ায় এসেছে।

রাজিয়ারা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন যে কয়টি কারণে তার মধ্যে একটি হলো স্বাভাবিক চলাফেরার অধিকার আদায়ের জন্য। যে সমস্যায় বেশি পড়ছেন তরুণীরা। চেকপয়েন্টে তাদের আটকে রেখে প্রথমে বলা হচ্ছে স্বামীকে ফোন করে ডেকে আনতে। একজনের সঙ্গে ফোন না থাকায় তাকে আবার বাড়ির ফিরতি ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দেয় তালেবানরা। বন্দুকের জোরে এমন নিয়ন্ত্রণ খাটানো কি মাথা ফাটানোর চেয়ে কম?

 

২৫ বছর আগের প্রতিধ্বনি

বিবিসির খবরে প্রকাশ, গত ১৫ আগস্টে কাবুলের অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে নারী বিচারকদের একটি কর্মশালা চলছিল। সেখানে তালেবান যোদ্ধারা এসে হানা দিলেও মরিয়ম রাজি নামের এক নারী বিচারক কর্মশালা চালিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ক্লাসের বাকিরা হার স্বীকার করায় মরিয়মও হয়ে পড়েন কোণঠাসা। দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি এখন এখানে সেখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

মরিয়মের তিন বছরের কন্যাশিশু নিলুফার বলেছিল ইঞ্জিনিয়ার হবে। তার খেলনা লেগোসেটটা এখন পড়ে আছে তাদের আগের ঘরের এক কোণে। বিবিসিসহ আরও অনেক গণমাধ্যমই আফগানিস্তানের অনেক নারীর সঙ্গে কথা বলেছে। তারা সবাই একটা বিষয়ে নিশ্চিত নন বলে জানিয়েছেন। আর তা হলো তালেবানরা বলেছিল, শরিয়ার ভেতর থেকে সকল নারী ও কিশোরীদের যাবতীয় অধিকার দেওয়া হবে। কিন্তু কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই। মরিয়মকে তো অফিসে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। মরিয়ম বিবিসিকে এক বাক্যেই বললেন, ‘আমার সব স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে গেছে।’

তালেবানের সিনিয়র কয়েকজন নেতার মতে, নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত হলেই তারা সব করতে পারবেন। তার আগ পর্যন্ত তাদের বাসা-বাড়িতেই থাকতে হবে। অবশ্য ওই ‘অনিরাপদ পরিবেশ’ ঠিক কারা তৈরি করে রেখেছে সেটা নিয়ে তেমন কিছু বলতে শোনা যায়নি ওদের।

১৯৯৬ সালে যখন তালেবানরা ক্ষমতা দখল করে তখনও একই ধরনের কথা বলেছিলেন দেশটির তৎকালীন ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টানেকজাই- ‘আমি তাদের (নারীদের) এইমাত্র বললাম যে, আপাতত এ সময়টার জন্য তারা যেন অফিস ও স্কুলে না যায়। নারীদের জন্য আলাদা করে একটা সমাধান নিয়ে আসা পর্যন্ত তারা যেন এটাই মেনে চলে।’ ২৫ বছর আগের কথার প্রতিধ্বনিই কিন্তু শোনা যাচ্ছে এখন। আর তালেবানের কথার পিঠে যে কথাটা না বললেও শোনা যাচ্ছে, সেটা হলো ‘আপাতত কেউ কোনও স্বপ্ন দেখবেন না। সময় হলে স্বপ্ন দেখার অনুমতি দেওয়া হবে (শর্তসাপেক্ষে)।’ সূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা, ফরেন পলিসি।