ঋণে জর্জরিত শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি আরও সংকটে

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ঋণের ভারে দ্বৈত সংকটে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। অর্থনৈতিক সংকট যত বাড়ছে ততই দেশটির জনগণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনীতির এমন পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার ক্রমবর্ধমান কঠিন বৈদেশিক ঋণ সংকটকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

মুডি’স অ্যানালিটিক্সের অর্থনীতিবিদ শাহানা মুখার্জীর মতে, নীতি নির্ধারকরা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ও দেশের চাহিদা মেটানোর দ্বৈত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছেন।

সেপ্টেম্বরে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে। এর ফলে মৌলিক খাদ্যপণ্য সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ ও বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পায় সরকার। জানুয়ারিতে দেশটির মূল্যস্ফীতি ১৪.২ শতাংশে পৌঁছেছে।

দক্ষিণ এশীয় দেশটির পর্যটন খাত থেকে আসা ডলারের প্রবাহ কমে গেছে মহামারিতে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর আগে থেকেই শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ সর্বোচ্চ ও অস্থিতিশীল পথে ছিল।

ইন্সটিটিউট অব পলিসি স্টাডিস অব শ্রীলঙ্কার নির্বাহী পরিচালক ডুশনি বিরাকুন বলেন, কীভাবে ঋণ শোধ করা হবে তা নিয়ে খুব একটা মাথা না ঘামিয়ে ২০০৭ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলো বন্ড ইস্যু করে গেছে। এক্ষেত্রে পণ্য ও সেবা রফতানি থেকে আয় নয়, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তোলা হয়েছিল ধার করে। এতে বড় ধাক্কা খেয়েছে শ্রীলঙ্কা।

ক্যাপিটাল ইকনোমিক্সের এশীয় অর্থনীতিবিদ অ্যালেক্স হোমস বলেন, সরকার বিদেশি মুদ্রা ঋণ পরিশোধে ব্যয় করেছে। কেন্দ্রীয় শ্রীলঙ্কান রুপির দরপতন ঠেকাতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমাচ্ছে। যা চাপে পড়েছে। এর ফলে খাদ্য আমদানির জন্য দেশটির অর্থনীতিতে বিদেশি মুদ্রা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল না। মুদ্রাস্ফীতি দুই অঙ্কে পৌঁছানোর পেছনে এটি একটি কারণ।

পর্যটন নির্ভর অর্থনীতির দেশটি করোনা মহামারিতে বড় ধাক্কা খেয়েছে। মুখার্জী বলেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে মহামারির প্রভাব ছিল ব্যাপক। গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব আয়ের খাত পর্যটন শিল্প ২০২০ সালের শুরু থেকে কার্যত বন্ধ থাকলে সরকারের আয় চাপে পড়ে। এই সময়ে অভিবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স পাঠানোও কমে আসে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৯ সালে কর কর্তন পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়। যার ফলে রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্য কমে যায় এবং কোভিড সংকটে দেশের অর্থনীতিকে সহযোগিতার ক্ষেত্রে সরকারের হাতকে দুর্বল করে দেয়।

বীরাকুন বলেন, ইতোমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়া পুঁজির প্রবাহের চ্যানেলগুলো মহামারিতে বন্ধ হয়ে যায় এবং ঋণ সূচক আরও খারাপ হয়। শ্রীলঙ্কার ক্রেডিট সূচকের অবনতি হয়, ঋণ পাওয়ার সক্ষমতাও হ্রাস পায়।

সিটি রিসার্চের তথ্য অনুসারে, ডিসেম্বরে রিজার্ভ ৩.১ বিলিয়ন ডলার থাকলেও জানুয়ারিতে তা কমে দাঁড়ায় ২.৩৬ বিলিয়ন ডলারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের পরবর্তী বড় চ্যালেঞ্জ হলো জুলাই মাসে ১ বিলিয়ন ডলার বন্ড পরিশোধ করা।

মুডি’স এর ধারণা মতে, ২০২২ সালেই প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে শ্রীলঙ্কাকে। আর্থিক খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারত ও চীনের দ্বারস্থ হয়েছে কলম্বো। জানুয়ারিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ি চীনকে ঋণ পরিশোধের কাঠামো পুনর্বিন্যাস করার অনুরোধ জানান। গত বছর দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও পিপল’স ব্যাংক অব চায়না মুদ্রা বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির আওতায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিময় করার সমঝোতা হয়। এই পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল আর্থিক অস্থিরতায় বিনিময় হারের ওঠানামার ঝুঁকি হ্রাস করা।

ভারতও সম্প্রতি শ্রীলঙ্কাকে ঋণ ও বিদেশি মুদ্রা বিনিময়ের প্রস্তাব দিয়েছে। এরমধ্যে জ্বালানি কেনার জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলারের লাইন অব ক্রেডিট রয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এরপরও সরকারকে আগামী কয়েক মাস কঠিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুখোমুখি হতে হবে। তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমদানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন ডলার সংরক্ষণ করা হবে নাকি আন্তর্জাতিক বন্ডধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় ঋণ ২০১৯ সালে ৯৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১ সালে জিডিপির ১১৯ শতাংশে পৌঁছেছে বলে ধারণা করা হয়।

ক্যাপিটাল ইকনোমিক্সের এশীয় অর্থনীতিবিদ অ্যালেক্স হোমস বলেন, সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে দেউলিয়া হওয়ার ইতিবাচকতা ও নেতিবাচকতার ভারসাম্য রক্ষা করা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার প্রয়োজন ঋণ অবকাঠামোর পুনর্বিন্যাস অথবা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর কাছে সহায়তা প্যাকেজ চাওয়া।

সিটি বিশ্লেষকরা বলছেন, আমরা মনে করি শ্রীলঙ্কা সরকার শেষ পর্যন্ত আইএমএফ-এর কাছে যাবে। যদিও আইএমএএফ-এর সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছানোর আগে দেউলিয়া ঘোষণার ঝুঁকি আমরা উড়িয়ে দিতে পারছি না।