কলকাতার মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাদ পড়ছে ‘সাপ-পেঁচা-বাদুড়’

বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের যা অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ, সেই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ এবার আয়োজিত হতে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার বুকেও। কিন্তু সেই শোভাযাত্রার উদ্যোক্তারা সাপ, মাছ, পেঁচার মতো প্রতীকগুলো বর্জন করে ঢাক, খোল বা কীর্তন-পটের গানের ওপর জোর দিচ্ছেন, যেগুলোকে তারা বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানার চিহ্ন বলে দাবি করছেন।

কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গে এবার বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হবে আগামী ১৫ এপ্রিল (শনিবার)। সেদিনই শহরের সংস্কৃতি-চর্চার প্রাণকেন্দ্র অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সামনে বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এই মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। কলকাতায় প্রথমবারের মতো এই শোভাযাত্রা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে ‘বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদ’ এবং ‘বাংলা আবার’ নামে একটি সামাজিক সংগঠন।

এই সংস্থাগুলো বলে থাকে, মুঘল বাদশাহ আকবর নন, বরং গৌড়ের হিন্দু রাজা শশাঙ্কই বাংলায় বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করেছিলেন। সেই বক্তব্যর পক্ষে তারা ওই রাজ্যে বেশ কিছুদিন ধরে প্রচার ও সচেতনতা অভিযানও চালাচ্ছেন। 

কলকাতায় মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার

বঙ্গাব্দ অনুযায়ী নতুন বছরের সূচনায় তারা যে নববর্ষ উদযাপন করছেন, সেই শোভাযাত্রাতেও তাই ‘হিন্দু বাঙালি’র ঐতিহ্যগত অভিজ্ঞানগুলোই তুলে ধরা হচ্ছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে সমার্থক হয়ে উঠেছে যে সব প্রতীক, সেগুলোকে তারা এড়িয়ে যাচ্ছেন সচেতনভাবেই।   

বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদের সম্পাদক প্রবীর ভট্টাচার্য যেমন এদিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘মহারাজা শশাঙ্ক যে বাংলা সন গণনার পদ্ধতি চালু করেছিলেন, আমরা তারই নববর্ষ পালন করতে যাচ্ছি। ফলে আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রাতেও তারই প্রতিফলন থাকবে।’

‘ঠিক এই কারণেই ঢাকার মতো সাপ-পেঁচা-বাদুড় নিয়ে আমরা নববর্ষের মিছিল করবো না। বরং আমাদের এই শোভাযাত্রায় বাজবে ঢাক ও শ্রীখোল। গাওয়া হবে কীর্তন ও বাউল। পরিবেশিত হবে গৌড়ীয় নৃত্য, পটের গান ও বাংলা কবিতা’ জানান তিনি। 

প্রবীর ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘ফলে বলতে পারেন আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা আলোকিত করবে বাঙালির মঙ্গলচিহ্ন, উপাসনা বাদ্য এবং মঙ্গল ধ্বজ!’

তবে বিগত দশকগুলোতে সাপ-পেঁচা-মাছকে যেভাবে বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ মঙ্গল শোভাযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছে, কলকাতায় সেটাকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে শহরের অনেকেই ভালোভাবে নিতে পারছেন না।

সমাজ বিশ্লেষক কল্যাণ শঙ্কর গোস্বামীর কথায়, ‘আমার মনে হচ্ছে এই সংগঠনগুলো তাদের হিন্দুত্ববাদী দর্শন থেকে ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বুঝতে একটা বড় ভুল করে ফেলেছেন। কারণ বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো সেটার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র, যে কারণে তা সে দেশেও হামেশাই ইসলামপন্থীদের আক্রমণের মুখে পড়ে। আর সেই শোভাযাত্রায় অসাম্প্রদায়িকতার চিহ্নগুলোই হল এই সাপ-পেঁচা-মাছ।’

ফলে শোভাযাত্রা থেকে সেই তথাকথিত সাপ-পেঁচা-বাদুড়কে বাদ দিয়ে এই মিছিলের উদ্যোক্তারা অসাম্প্রদায়িক চেতনাতেই আঘাত হানছেন বলে অধ্যাপক গোস্বামী মনে করছেন।

কলকাতায় মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে এই অ্যাকাডেমি চত্বরে

কলকাতায় মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্যোক্তারা আবার বলছেন, কোনও ধর্মীয় চেতনা নয়, তাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো বাংলা নববর্ষে বাঙালিয়ানার সাবেকি প্রতীকগুলোর হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা।

‘এই কারণেই আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে বাংলা ভাষা, বাঙালির নিজস্ব সঙ্গীত কীর্তন, বাঙালির নিজস্ব নাচ গৌড়ীয় নৃত্য, বাঙালির বাদ্য শ্রীখোলের শাস্ত্রীয় মর্যাদার দাবি করছি’ বলছিলেন প্রবীর ভট্টাচার্য। 

তবে কলকাতার বিশিষ্ট নাট্যকর্মী ও পরিচালক জয়রাজ ভট্টাচার্য আবার মনে করছেন, সাপ-পেঁচা-মাছকে বাদ দিলে সেই মিছিলকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে ডাকারই কোনও অধিকার উদ্যোক্তাদের নেই। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা মানেই মাছের মোটিফ, পেঁচার মোটিফ ইত্যাদি– বাংলাদেশ সেটাকে প্রায় পেটেন্ট করে ফেলেছে। এখন কেউ যদি কলকাতায় নববর্ষে খোল-কর্তাল নিয়ে মিছিল করতে চান করুন না, কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু দয়া করে সেটাকে অন্য যে কোনও নামে ডাকুন, মঙ্গল শোভাযাত্রা বলবেন না প্লিজ।’