লোকসভা নির্বাচন

বিজেপি ও তৃণমূলের মাথাব্যথা এখন কম ভোটার উপস্থিতি

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে তৃতীয় ধাপের ভোটের আগে আলোচনায় রয়েছে ভোটার উপস্থিতি। প্রথম দুই ধাপের ভোটের হার প্রত্যাশা অনুযায়ী না হওয়ার কারণে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস কিছুটা উদ্বিগ্ন। তৃতীয় ধাপেও ভোটার উপস্থিতি আশানুরূপ না হলে তা দল দুটির ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ভারতজুড়ে চলছে ১৮তম লোকসভা নির্বাচন। সাত ধাপের এই নির্বাচনে এখন পর্যন্ত দুই দফায় ১৯০টি আসনে ভোট হয়েছে। মঙ্গলবার তৃতীয় ধাপের ভোট অনুষ্ঠিত হবে। তবে প্রথম দুই ধাপে ভোটারের উপস্থিতি সন্তোষজনক নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। যে পরিমাণ ভোটের আশা ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলগুলো করছিল, তা অনেকটা পূরণ হয়নি। নির্বাচনের আগেই মোদি সরকার ‘৪০০ আসনে’ জয়ী হওয়ার আশা প্রকাশ করেছিল। তবে বিশ্লেষকদের ধারণা, দুই ধাপে অনুষ্ঠিত ভোটে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি ক্ষমতাসীন দলটি। প্রাথমিকভাবে অনুষ্ঠিত এই দুই ধাপের ভোটারের গড় উপস্থিতি, মুসলিমবিদ্বেষী বক্তৃতা এবং নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও উঠেছে। তাই তৃতীয় ধাপের ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে তোড়জোড় চালিয়েছে মোদির দল।

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ১৯ ও ২৭ এপ্রিল এই দুই ধাপে মোট ১৯০টি আসনে আনুমানিক ভোট পড়েছিল প্রায় ৬৬ শতাংশ, যা ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় প্রায় তিন শতাংশ কম।

দ্বিতীয় ধাপের ভোটে ৭৬.৫৮ শতাংশ ভোটার উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও মোট ভোটারের সংখ্যা ৪.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের একটি অংশ বলছেন, সাত ধাপের এই নির্বাচনের মাত্র দুটি ধাপের ভোট শেষ হয়েছে। বাকি রয়েছে আরও ৫টি ধাপের ভোট। তাই এর মধ্যে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম বলাটা ভুল হবে।

ভোটকেন্দ্রে ভোটারের কম উপস্থিতি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলগুলো। এর কারণ খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। পশ্চিমবঙ্গে ভোট কম হওয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য যতটা না উদ্বেগের, ততটাই ঠিক মোদির জন্যও। নির্বাচনে অনাগ্রহী ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনাটাই এখন তাদের বড় চ্যালেঞ্জ।

নরেন্দ্র মোদি। ছবি: পিটিআই

ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার জন্য বিরোধীদের দায়ী করেছেন বিজেপি নেতা ও ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। ৬৬-৬৭% ভোটারের উপস্থিতি কম বলা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, বিরোধী জোট তাদের সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে আনতে এবং ভোট দেওয়ার জন্য উৎসাহ দিতে পারেনি। বিকল্প হিসেবে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ওপর তারা আস্থা হারিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।

তবে ভিন্ন কারণ হাজির করেছেন বিজেপির আরেক নেতা ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। লোকসভার প্রথম দুই ধাপের ভোটে কম ভোটার উপস্থিতির জন্য তিনি পুরনো ধাঁচের নির্বাচনি প্রচারণা এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বীহীন’ নির্বাচনের কথা বলেছেন।

তিনি বলেছেন, ভোটারের কম উপস্থিতির অনেক কারণে রয়েছে। ১২ বছর পর পুরনো ধাঁচের নির্বাচনি প্রচারণা পুনরায় বিবেচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ হলো, বিজেপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কোনও প্রতিপক্ষ নেই, যা ভোটারের উপস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে।

উত্তরাঞ্চলীয় হরিয়ানার রাজ্যে বিজেপির প্রচারণা কমিটির সদস্য সঞ্জয় শর্মা বলেছেন, ‘মূলত কর্মী ও ভোটারদের অনাগ্রহের কারণেই ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি কম হয়েছে।’

বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র গোপাল কৃষ্ণ আগারওয়াল বলেছেন, “ভোটারের সংখ্যা ‘প্রত্যাশার চেয় কম’ ছিল। তবে তা মূল ফলাফলে কোনও প্রভাব ফেলবে না।”

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে দলের জয়ের বিষয়ে এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে পড়ায় ভোট নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন অনেকে।’

বিজেপির নির্বাচনি প্রচারণার কারণে কিছু ভোটারদের প্রতিক্রিয়া হিতে বিপরীত হয়েছে। ছত্তিশগড় রাজ্যের রাজনন্দ গ্রামের একজন ভোটার বিকাশ কুমার। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন নিয়ে বিজেপির কাজের চেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক প্রচারণায় আমরা ভোটে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।’

উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌর একজন দোকানদার কামাল আব্বাসের মধ্যেও নির্বাচন নিয়ে কোনও আগ্রহ দেখা যায়নি। তিনি জানান, মোদির দলের জয় যেহেতু নিশ্চিত, তাই টাকা খরচ এবং সময় নষ্ট করে নিজ গ্রাম প্রজ্ঞা রাজে গিয়ে ভোট দেওয়ার কোনও প্রয়োজন বোধ করছেন না তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাসীন দলের সামনে সংখ্যালঘুদের ভোটের কোনও মূল্য নেই…তাই শুধু শুধু সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।’

উত্তর প্রদেশে বিজেপির একজন জেলা নির্বাচনি ম্যানেজার অনিরুধ সিং। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে নির্বাচন হলে দলটি বিপুল নির্বাচনি সুবিধা পেতে পারতো। কেননা, তখন রাম মন্দির নির্মাণ নিয়ে সবার মধ্যে উত্তেজনা চরমে ছিল।’

তবে ইতোমধ্যে ধর্মীয় সুখানুভূতিকে আড়াল করে কর্মসংস্থান ও মূল্যস্ফীতির মতো উদ্বেগের জন্ম হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মন্দির উদ্বোধনের পর মোদির জন্য জনসমর্থন নিশ্চিত করায় ব্যর্থ হয়েছে দলটি।’

নির্বাচনে কোনও পরিবর্তনের আশা করলে মোদিকে তার কর্মী ও সমর্থকদের আবারও উৎসাহিত করতে পদক্ষেপ নিতে হবে উল্লেখ করে রাজনৈতিক ভাষ্যকার জেরাথ বলেছেন, ‘এখন আর কোনও সাম্প্রদায়িক বা রাম মন্দিরের উত্তেজনা নেই।’

কংগ্রেস দলের জেনারেল সেক্রেটারি জেইরাম রামেশ বলেন, নির্বাচনি প্রচারণায় মোদির ভাষা ও কথার ধরনে এখন ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনি প্রবণতায় মোদি নিয়ে এখন আর সেই উত্তেজনা নেই। ২০১৯ সালে যেসব রাজ্যে আমরা তেমন কোনও সাড়া পাইনি, সেগুলোতে এবার ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।’

অ্যামহার্স্ট কলেজের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক গিলস ভার্নিয়ার্স বলেন, ‘বিজেপি এখন তাদের প্রত্যাশাকে পুনরায় বিবেচনা করতে শুরু করেছে এবং এই মুহূর্তে তাদের কিছুটা অসংগঠিত বলেও মনে হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারপরও, যেহেতু এটি অনেক বড় ও দীর্ঘ একটি নির্বাচন, তাই যেকোনও মুহূর্তেই বড় কোনও ঘটনা ঘটে যেতে এবং চমকও আসতে পারে।’

কারণ যাই হোক, ভোটারের কম উপস্থিতি মোদির বিজেপি ও মমতার তৃণমূল কংগ্রেসকে ভাবাচ্ছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেতে এক নিবন্ধে রাজনৈতিক বিশ্লেষক শিখা মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, বিজেপির লক্ষ্য ও প্রত্যাশা পূরণে এটি একটি খারাপ সংবাদ, এতে কোনও সন্দেহ নেই। এটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যও একটি দুঃসংবাদ। তিনি রাজ্যে ২০১৯ সালে ২২টি আসনে জয় পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার চাইছেন ৩৪টি আসনে জিততে। ২০১৪ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবেঁধে ৩৪ আসনে জয়ী হয়েছিল তার দল। তিনি বিজেপিকে একটি আসনও জিততে দিতে চান না। এমনকি দলের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে, বিজেপি যদি ১০টির কম আসন জিতে তবে তার উদ্দেশ্য পূরণ হবে।

তিনি আরও লিখেছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের নিবেদিত ভোটাররা যদি বিজেপির চেয়ে বেশি কেন্দ্রে আসে, তাহলে এক ধরনের ফল আসবে। কিন্তু উল্টোটা ঘটলে ফলাফল পাল্টে যাবে। বিশেষ কোনও কিছু ছাড়া এবং কম ভোটার নিয়ে উদ্বেগের নির্বাচন একটি একক প্রশ্নে এসে দাঁড়াবে: কোন নেতা কম খারাপ, মোদি নাকি মমতা?

সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে, রয়টার্স, ইকনোমিক টাইমস ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস