বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। একমাস ধরে চলা বিক্ষোভ ওই দিন তীব্রতা লাভ করেছিল। হাসিনার সরকারের দমনমূলক কৌশল বৃদ্ধি পেলেও হঠাৎ করেই পরিস্থিতি অপ্রত্যাশিত মোড় নেয়।
এখন বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলো এই অপ্রত্যাশিত অস্থিরতার মোকাবিলা করতে চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতীক ছিল। যদিও তা স্বৈরাচারী ছিল।
চীনের জন্য শেখ হাসিনার উৎখাত বিপদ এবং সুযোগ উভয়ই নিয়ে এসেছে। চীনা সরকারও এটি বুঝতে পেরেছে। বেইজিং এখনও এ ব্যাপারে কোনও বিশদ মন্তব্য করেনি। কেবল একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রকাশ করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এক লিখিত বিবৃতিতে বলেছেন, চীন বাংলাদেশের ঘটনার প্রতি নিবিড় নজর রাখছে। বাংলাদেশের একটি বন্ধুবৎসল দেশ ও কৌশলগত অংশীদার হিসেবে চীন আশা করে দেশটিতে দ্রুত সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া কেবল একটি সংক্ষিপ্ত সংবাদ প্রকাশ করেছে। যাতে সেনাপ্রধানের শান্তি বজায় রাখার আহ্বানের কথা গুরুত্ব পেয়েছিল।
স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্ব চীনের মূল উদ্বেগকে তুলে ধরছে। চীন তার প্রতিবেশী অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা চায় না। যদিও বাংলাদেশ চীনের সীমান্তে নেই। তবু দুই দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।
সেন্টার ফর স্টিমসনের চীনা প্রোগ্রামের পরিচালক ইয়ুন সান দ্য ডিপ্লোম্যাটকে ইমেইলে বলেছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা মানে অস্থিতিশীলতা, যা চীন দেখতে চায় না। এটি চীনা প্রকল্পগুলোর জন্য আরও অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা নিয়ে আসবে।
চীন সি জিনপিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় বাংলাদেশে ক্রমাগত সক্রিয় হয়েছে। ধারণা করা হয়, চীন ২০১৯-২০২০ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশকে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। যা মোট ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশ। বর্তমানে প্রায় ১৪টি প্রকল্প চীনের ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে, একটি চীনা কোম্পানি পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে। যেটিকে শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকে একটি সফল অর্জন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল।
ইয়ুন উল্লেখ করেছেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে স্বস্তিতে ছিল চীন। দুই পক্ষ তাদের সম্পর্ককে ‘ব্যাপক কৌশলগত সহযোগী অংশীদারত্ব’ স্তরে উন্নীত করেছে জুলাইয়ে শেখ হাসিনার বেইজিং সফরে। একই সফরে, চীন ও বাংলাদেশ ২০টির বেশি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
তবে, চীন বাংলাদেশে কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছে শেখ হাসিনার চীন ও ভারতের স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টার কারণে। চীন বাংলাদেশে অর্থায়ন বাড়ালেও সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ বাতিল করেছে ঢাকা। এটি একটি চীনা কোম্পানি নির্মাণ করতে চেয়েছিল। ভারত মহাসাগরে চীনা কোম্পানি দ্বারা নির্মিত এমন বন্দর প্রকল্পগুলো ভারতের উদ্বেগের কারণ। দিল্লি করে দ্বৈত ব্যবহারের সুযোগ থাকা এসব বন্দরে চীন নজরদারি জাহাজ মোতায়েন করতে পারে।
সম্প্রতি, ভারতের প্রস্তাবিত ১ বিলিয়ন ডলারের তিস্তা নদী জল ব্যবস্থাপনা প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে শেখ হাসিনা চীনের ক্ষোভের কারণ হতে পারেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই কারণেই চীন হাসিনার সাম্প্রতিক বেইজিং সফরের সময় ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশের প্রভাবের প্রতিযোগিতায় ভারতের সঙ্গে চীনের পিছিয়ে পড়া বেইজিংয়ের চলমান পরিস্থিতি অপ্রত্যাশিত সুবিধায় পরিণত হতে পারে। ধারণা করা হয়, নয়া দিল্লি শেখ হাসিনাকে সমর্থন করে আসছিল। এই সমর্থনের কারণে বিরোধীদের ওপর শেখ হাসিনার দমনমূলক পদক্ষেপের বিষয়ে নীরব ছিল। এমনকি মনে করা হয়, তার স্বৈরাচারী পদক্ষেপের সমালোচক যুক্তরাষ্ট্র সরকারকেও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত রেখেছিল দিল্লি।
এই সম্পর্কটি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে ভারত এবং শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের মনে ছিল। ২০২৪ সালের বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচনের পর ভারতবিরোধী প্রচারণা শুরু হয়। বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ উঠে ভারতের বিরুদ্ধে।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের ফলে শুধু আওয়ামী লীগের ওপর ভারতের ভরসা করার নীতি ভুল ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে। ঋণ দাতা ও অংশীদার হিসেবে নতুন সরকার গঠনে বড় ভূমিকা রাখতে চাইবে বেইজিং। বিশেষ করে সম্ভাব্য নতুন নির্বাচনের পূর্বে।
উল্লেখ্য, জুনের শেষদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টির (বিএনপি) সহ-সভাপতি আবদুল আওয়াল মিন্টু চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান লিউ জিয়াঙ্কাওয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এ সময় লিউ ঢাকা সফরে এসেছিলেন। ভারতীয়দের কাছে প্রধান বিরোধী দল ও আগামী ক্ষমতায় আসার জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দল বিএনপিকে ‘ভারতবিরোধী’ এবং ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণার জন্য দায়ী।
ইয়ুন বলেছেন, বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে ভারতের প্রভাবের মধ্যে বলে বিবেচনা করা হয়। যদি সরকার পরিবর্তনের ফলে এটি প্রভাবিত হয়ে থাকে তাহলে আমি মনে করি না এতে চীন নিজেকে এই রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে মনে করবে।
এরপরও চীন শেখ হাসিনার উৎখাত নিয়ে আনন্দিত না। এমনকি এতে ভারতের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বেইজিংয়ের অবস্থান ভালো হলেও। প্রথমত, চীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তাকে ভারতের চেয়ে বেশি সমর্থন করেনি। বেইজিং শেখ হাসিনার নির্বাচনি বিজয়কে সমর্থন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অপর দেশগুলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য তিরস্কার করেছে।
বাংলাদেশে বিক্ষোভ জোরালো হতে থাকলেও শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছিল চীন। এই বিষয়টি চলমান অস্বস্তিকর সময় আওয়ামী লীগ থেকে চীনের নিজেকে আলাদা করার প্রচেষ্টাকে ক্ষুণ্ন করবে। যদিও চীন ভারতের চেয়ে এই প্রচেষ্টায় অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট অবলম্বনে।