পহেলগামে হামলা

কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানি সেনাপ্রধানের পুরনো বক্তব্যে ভারতে ক্ষোভ

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির সাধারণত প্রকাশ্যে আলোচনায় খুব একটা থাকেন না। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে তিনি শুধু পাকিস্তানেই নয়, প্রতিবেশী ভারত ও অন্যান্য দেশের কূটনৈতিক মহলে আলোচিত হচ্ছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক  প্রতিবেদনে এসব কথা উঠে এসেছে।

ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে জঙ্গি হামলার মাত্র কয়েক দিন আগে তার কাশ্মীর সংক্রান্ত বক্তব্য আঞ্চলিক উত্তেজনা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ২৬ জন নিহত হওয়া ওই হামলার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হলেও জেনারেল মুনির বক্তব্যকে অনেকেই পাকিস্তানের আরও আগ্রাসী অবস্থানের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। 

কী বলেছিলেন আসিম মুনির?

গত ১৭ এপ্রিল ইসলামাবাদে প্রবাসী পাকিস্তানিদের এক সমাবেশে মুনির বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দুদের থেকে সব দিক থেকে আলাদা।’ কাশ্মীরকে পাকিস্তানের ‘জুগুলার ভেইন’ (জীবনরেখা) আখ্যা দিয়ে তিনি শপথ নেন যে পাকিস্তান কখনোই ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কাশ্মীরিদের সংগ্রামে পাশে দাঁড়াতে বিরত থাকবে না। 

এই বক্তব্যের মাত্র পাঁচ দিন পর ২২ এপ্রিল ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে জঙ্গিরা পর্যটকদের ওপর গুলি চালায়। এটি গত দুই দশকের মধ্যে নিহতের সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা ছিল। 

এই বক্তব্যকে ভারতের প্রতি এক ধরনের প্রকাশ্য হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এমনকি পাকিস্তানের কূটনৈতিক মহলেও এতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক জোশুয়া টি হোয়াইট বলেন, “বক্তব্যের ভেতরের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি পাকিস্তানের চিরাচরিত অবস্থানের সঙ্গে মিল থাকলেও, ‘হিন্দু-মুসলমান পার্থক্যের সরাসরি উল্লেখ’ এটিকে বিশেষভাবে উসকানিমূলক করে তুলেছে।”

বিশ্লেষকদের মতে, জেনারেল মুনিরের বক্তব্য সাধারণ রুটিন মতামত নয় বরং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্তমান মনোভাবের প্রতিফলন। সাম্প্রতিক হামলার জন্য ইসলামাবাদকে দায়ী করছে নয়াদিল্লি, যদিও পাকিস্তান সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে জেনারেল মুনিরের বক্তৃতা ও তার পরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ভারতের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য পাল্টা পদক্ষেপের শঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে।

ফেব্রুয়ারিতে মুজাফফরাবাদে কাশ্মীর সংহতি দিবস উপলক্ষে দেওয়া আরেক বক্তব্যে মুনির বলেন, ‘কাশ্মীরের জন্য পাকিস্তান ইতোমধ্যে তিনটি যুদ্ধ করেছে, দরকার হলে আরও ১০টি করবে।’

জেনারেল আসিম মুনির

কে এই জেনারেল মুনির?

জেনারেল মুনিরের বয়স এখন ৫০-এর কোঠায়। ১৯৮৬ সালে মাংলার অফিসার্স ট্রেনিং স্কুল থেকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেখান থেকে সেরা ক্যাডেট হিসেবে ‘সোর্ড অব অনার’ পান। পরে তাকে ২৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টে কমিশন দেওয়া হয়। 

প্রায় চার দশকের কর্মজীবনে মুনির কাশ্মীর সংলগ্ন পাকিস্তানের সংবেদনশীল উত্তরাঞ্চলের সীমান্তে সেনা পরিচালনা করেছেন, গোয়েন্দা বাহিনী নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সৌদি আরবে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদারে ভূমিকা রেখেছেন। ইসলামাবাদের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি থেকে পাবলিক পলিসি ও স্ট্র্যাটেজিক সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করেছেন। এ ছাড়া জাপান ও মালয়েশিয়ার সামরিক প্রতিষ্ঠানেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। 

সাবেক আইএসআই প্রধান থেকে সেনাপ্রধান

২০২২ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হন মুনির। তার নেতৃত্ব গ্রহণের সময় দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট ও জনগণের মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রতি হতাশা বিরাজ করেছিল। 

তার নিয়োগের পেছনে মাসাধিককাল ধরে জল্পনা-কল্পনা চলছিল, মূলত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে তার সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে। মুনির মাত্র আট মাস পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর ইমরান খান তাকে সরিয়ে দেন। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এটা ছিল ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। 

বর্তমানে ইমরান খান কারাগারে, আর মুনির দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। 

সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নাম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো আবদুল বাসিত বলেছেন, মুনিরের সামনে জরুরি কিছু চ্যালেঞ্জ আছে—সন্ত্রাসবাদের উত্থান, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সংকট ও আঞ্চলিক উত্তেজনা। তার পক্ষে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নেওয়া সম্ভব নয়। তাকে দ্রুত ও দৃঢ় সাড়া দিতে হবে। 

রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আমির জিয়া বিবিসিকে বলেছেন, কাশ্মীর পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ। পাকিস্তানের প্রতিটি শিশুকে স্কুলে এ শিক্ষা দেওয়া হয় যে ভারতকে কোনও সুযোগ দেওয়া যাবে না।

জেনারেল মুনিরের মেয়াদ এখনও প্রায় তিন বছর বাকি। ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা কূটনৈতিকভাবে নিষ্পত্তি হবে নাকি সামরিক সংঘাতে রূপ নেবে—তা অনেকটাই নির্ভর করছে মুনিরের নেতৃত্বের ওপর। 

বিশ্লেষক বাসিত বলেন, এই কয়েক সপ্তাহই ঠিক করে দেবে ইতিহাসে মুনির কীভাবে লেখা হবেন — একজন সেনানায়ক, একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি, না কি দক্ষিণ এশিয়ার নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার নির্মাতা।