ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়া সিরিয়ার জনগণের ক্ষোভ এখন দেশটির নতুন সরকারের বিরুদ্ধে। পাঁচ দিনেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েল সিরিয়ার আকাশসীমা ব্যবহার করে ইরানে হামলা চালালেও এ নিয়ে এখনও মুখ খোলেনি দামেস্ক। অন্যদিকে, সীমান্তবর্তী এলাকায় সিরীয়দের জীবন হয়ে উঠেছে আতঙ্কে ভরা। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই এ খবর জানিয়েছে।
দক্ষিণ সিরিয়ার দারা ও কুনেইত্রা প্রদেশে বসবাসকারী বহু মানুষ প্রতিদিনই ইসরায়েলি জঙ্গিবিমানের গর্জন আর দূর থেকে ভেসে আসা বিস্ফোরণের শব্দে চমকে উঠছেন। মার্কিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ওই অঞ্চলে ইরানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দারাভিত্তিক মানবাধিকারকর্মী ইমাদ আল বাসিরি মিডল ইস্ট আইকে বলেন, মানুষ চরম উদ্বিগ্ন। বিস্ফোরণের শব্দ ভয়ংকর, আর ড্রোন ভেঙে পড়ে ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে, কৃষিজমিতে আগুন লেগেছে।
১৩ জুন শুরু হওয়া ইসরায়েলের ধারাবাহিক হামলায় ইরানের বহু সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাকে নিশানা করা হয়েছে। নিহত হয়েছেন দেশটির শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীরা। বেসামরিক হতাহতও শত শত।
ইরান পাল্টা জবাবে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইসরায়েলের দিকে। তেলআবিব ও হাইফার মতো বড় শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও বহু মানুষের প্রাণহানির খবর মিলেছে।
সিরিয়ার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশটির আকাশপথ যেন দুই পক্ষের হামলার প্রধান পথ হয়ে উঠেছে। এই লড়াইয়ে সিরিয়ার ভূমিতে পড়ছে যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ—বিশেষ করে গোলান মালভূমির কাছে কুনেইত্রা ও দারায়।
বাসিরি বলেন, সাধারণ মানুষ অসহায়। সিরিয়ার সরকার পুরোপুরি চুপ। সীমান্ত পাহারার কোনও চিহ্ন নেই।
গত বছরের ৮ ডিসেম্বর বিদ্রোহীদের হাতে দীর্ঘ ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে বাশার আল আসাদ সরকার পতনের পর সিরিয়ায় একটি নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু সেই সরকারও ইসরায়েল বা ইরানের কেউ আকাশসীমা লঙ্ঘন করল কি না—সে বিষয়ে কোনও বক্তব্য দেয়নি।
এর মধ্যে প্রতিবেশী ইরাক জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করেছে ইসরায়েলের বিমান তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করায়। সিরিয়ার পক্ষ থেকে তেমন কিছু দেখা যায়নি।
বাসিরি বলেন, সীমান্তে সিরিয়ার বাহিনী নেই বললেই চলে। ইসরায়েলি বাহিনী নিয়মিত ঢুকে ধরপাকড় চালাচ্ছে। গত সপ্তাহে একজনকে হত্যা করেছে।
সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটসের পরিচালক ফাদেল আব্দুল গানি বলেন, জাতিসংঘ সনদের ৩৫ ও ৫১ অনুচ্ছেদের আওতায় সিরিয়া নিরাপত্তা পরিষদে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করতে পারে। সরকারকে এখনই কূটনৈতিক প্রচার চালাতে হবে।
তিনি বলেন, সিরিয়া যেন মানবিক ফ্লাইট করিডোর চায়। নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত করে তার আকাশসীমা যেন কোনও পক্ষের যুদ্ধক্ষেত্র না হয়, সে দাবি তুলতে হবে।
তবে এখন পর্যন্ত সিরিয়ার প্রতিক্রিয়াকে অপর্যাপ্ত বলেই মনে করছেন গানি। তার মতে, সরকারের উচিত আরব লিগ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় গড়ে তুলে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় কৌশল প্রণয়ন করা।
সুয়েইদার স্থপতি সামার আবু রাসলান মিডল ইস্ট আইকে বলেন, সিরিয়াকে এখন দুর্বল ও অসুস্থ রাষ্ট্রের মতো মনে হচ্ছে। আমি একজন নাগরিক হিসেবে চাই, আমার আকাশ, মাটি ও পানি যেন সব রকম আগ্রাসন থেকে সুরক্ষিত থাকে।
দামেস্কভিত্তিক সাংবাদিক লিনা (তিনি পুরো নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, সিরিয়ার সরকার এমনকি প্রত্যুত্তরের অধিকার সংরক্ষণের এই পুরোনো ভাষাটিও ব্যবহার করছে না। আগে আসাদের আমলেও তো এটা বলা হতো।
তিনি মনে করেন, সরকারের নীরবতা এতই সন্দেহজনক যে, সিরিয়া এই যুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিয়েও কার্যত একটি পক্ষ হয়ে গেছে।
সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা মনে করছেন, নতুন সরকারের এই নিরবতা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে শুধু আন্তর্জাতিক আইন নয়, নিজেদের জনগণের কাছেও সরকার আস্থা হারাবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশের জন্য সীমান্ত, আকাশ ও নিরাপত্তা ইস্যুতে চুপ থাকা ভবিষ্যতের জন্য হুমকি তৈরি করবে।