ট্রাম্পের ছায়ায় যুদ্ধবিরতি হলেও চীনের সঙ্গে বন্ধন পুনঃনিশ্চিত করলো পাকিস্তান

ভারতের সঙ্গে চার দিনব্যাপী উত্তেজনার পর পরবর্তী সংকট-পরিস্থিতিতে সহায়তার জন্য আবারও বিশ্বস্ত মিত্র চীনের দিকে মুখ ফিরিয়েছে পাকিস্তান।

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করে গত মে মাসের শুরুর দিকে পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটি ও শহরগুলোর ওপর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় ভারত। এসময় পাকিস্তান আত্মরক্ষায় নির্ভর করে এক অপ্রত্যাশিত সমন্বয়ের ওপর। এগুলো হলো চীনের ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান প্রতিরক্ষা, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান এবং মার্কিন কূটনীতি।

এই ক্ষেপণাস্ত্র, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং যুদ্ধবিমান পাকিস্তানকে তার বিমান ঘাঁটিগুলোতে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছে। পাকিস্তান দাবি করে যে তারা একাধিক ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। যদিও ভারত এ বিষয়ে এখনও কিছু নিশ্চিত বা অস্বীকার করেনি।

মার্কিন কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অবশেষে একটি যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করে, যেটিকে পাকিস্তান প্রকাশ্যে স্বাগত এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনকে কৃতজ্ঞতা জানায়।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের বদলে ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অংশীদার হিসেবে বেছে নেওয়ায়, পাকিস্তান এই সপ্তাহে চীনকে আশ্বস্ত করে যে বেইজিংই রয়ে গেছে তাদের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মিত্র।

পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এই সপ্তাহের শুরুতে বেইজিং সফর করেন। গত মঙ্গলবার (২০ মে) তিনি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির পর এটিই ছিল কোনও পাকিস্তানি শীর্ষ নেতার প্রথম উচ্চপর্যায়ের বিদেশ সফর।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতি অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে স্বল্পমেয়াদি হলেও তীব্র সংঘর্ষ, যুদ্ধবিরতি এবং নয়াদিল্লির পদক্ষেপ নিয়ে ইসলামাবাদের সমালোচনার বিষয়গুলো স্থান পায়।

ফলে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়া যখন সাম্প্রতিক পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনার সময় বিস্ফোরক এক পরিস্থিতির মধ্যে ছিল, তখন পটভূমিতে চলছিল আরও বৃহৎ এক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা।

এক সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র পাকিস্তান এখন দৃঢ়ভাবে চীনের প্রভাব বলয়ে চলে গেছে এবং তার উত্তর-পশ্চিম প্রতিবেশীর ওপর অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তার জন্য ব্যাপকভাবে নির্ভর করছে।

অন্যদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মূলত চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় একটি কৌশলের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হয়েছে ভারত।

লাহোর কলেজ ফর উইমেন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং পাকিস্তান-চীন সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ শাহিদ আলী বলেন, ইসহাক দারের সফরের সময় ও বার্তা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘যদিও পাকিস্তান চেয়েছিল ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার বিষয়ে, বিশেষ করে সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করার ব্যাপারে চীনের পূর্ণ কূটনৈতিক সমর্থন পেতে। এই সফরটি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে হওয়া যুদ্ধবিরতির প্রক্রিয়া সম্পর্কে চীনকে অবহিত করতে দারকে একটি সুযোগ দেয়। একই সঙ্গে পাকিস্তান-চীন দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অংশীদারত্বের নিশ্চয়তা দেওয়ারও বিষয়টিও তুলে ধরে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক পাকিস্তান-চীন সম্পর্ক ও চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর সংক্রান্ত গবেষক ইরাম আশরাফও এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত। দশ বছর আগে শুরু হওয়া ৬২ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প এখনও পাকিস্তান-চীন অংশীদারত্বের অন্যতম প্রধান ভিত্তি।

আল জাজিরাকে ইরাম বলেন, ‘এই বৈঠকের মাধ্যমে চীন বুঝতে পারবে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার ফলে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছেন তিনি। কারণ যুদ্ধবিরতির জন্য কীভাবে পাকিস্তান ট্রাম্পের সমর্থন পেলো, এমনকি কাশ্মির ইস্যু সমাধানে মধ্যস্থতার প্রস্তাবের মতো বিষয়েও; তা নিয়ে চীনের উদ্বেগ রয়েছে। চীন চিন্তিত যে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রভাব কীভাবে তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক স্বার্থে প্রভাব ফেলতে পারে।’

আর চীনে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাসুদ খালিদ বলেন, যুদ্ধবিরতির পর ভারতের সঙ্গে সৃষ্ট সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার কূটনৈতিক উদ্যোগে বেইজিংই ছিল ইসলামাবাদের জন্য ‘যুক্তিযুক্ত’ প্রথম গন্তব্য।

সূত্র: আল জাজিরা