ভারতে অ্যান্টিবায়োটিক সংকটে বাড়ছে ‘সুপারবাগ’

অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে বিপর্যয়কর এক দ্বৈত চিত্র দেখা যাচ্ছে ভারতে। একদিকে এমন ওষুধের অতিব্যবহারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী গড়ে তুলছে, তৈরি হচ্ছে প্রাণঘাতী ‘সুপারবাগ’। অন্যদিকে, প্রয়োজনের সময় এই জীবনরক্ষাকারী ওষুধই বহু মানুষের নাগালের বাইরে রয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।

গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, কার্বাপেনেম-প্রতিরোধী গ্রাম-নেগেটিভ (সিআরজিএন) জীবাণুর সংক্রমণে আক্রান্ত প্রায় ১৫ লাখ রোগীর মধ্যে মাত্র ৬.৯ শতাংশ উপযুক্ত চিকিৎসা পেয়েছেন। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল ভারতসহ আটটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ।

দ্য ল্যানসেট ইনফেকশিয়াস ডিজিজেস জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে সিআরজিএন সংক্রমণের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। চিকিৎসা পেয়েছে মাত্র ৭.৮ শতাংশ আক্রান্ত।

গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া সাধারণত পানি, খাবার, পরিবেশ এমনকি মানুষের অন্ত্রে বাস করে। এটি মূত্রনালী সংক্রমণ, নিউমোনিয়া ও ফুড পয়জনিংয়ের মতো অসুখ ঘটায়। হাসপাতালের আইসিইউতে এই জীবাণু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিরোধশীল হওয়ায় অনেক সময় চিকিৎসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল গফুর বলেন, এই সংক্রমণ এখন সব বয়সেই দেখা যায়। প্রায়ই এমন রোগী আসেন, যাদের জন্য কোনও অ্যান্টিবায়োটিকই আর কাজ করে না—এবং তারা মারা যান।

এই সংকটের বড় কারণ হলো, কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সীমিত প্রাপ্যতা ও দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা। গবেষণায় দেখা যায়, আটটি দেশে টাইজেসাইক্লিন নামের একটি কার্যকর ওষুধের মাত্র ১ লাখ ৩ হাজার কোর্স সংগ্রহ করা হয়েছে—যেখানে রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ লাখ।

গবেষণা প্রতিবেদনের প্রধান লেখক ও গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ-এর  গ্লোবাল অ্যাক্সেস পরিচালক ডা. জেনিফার কন বলেন, অনেক বছর ধরে বলা হচ্ছে, অ্যান্টিবায়োটিক অতিরিক্ত ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, উন্নয়নশীল দেশে বহু মানুষ অত্যন্ত ওষুধপ্রতিরোধী সংক্রমণে ভুগলেও দরকারি অ্যান্টিবায়োটিক পাচ্ছেন না।

ভারতের রোগীরা কেন সঠিক ওষুধ পাচ্ছেন না, তার পেছনে রয়েছে একাধিক বাধা।  সঠিক হাসপাতাল পাওয়া, নির্ভরযোগ্য ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা, ও কার্যকর ওষুধের নাগাল। এসব অ্যান্টিবায়োটিকের উচ্চমূল্য দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে।

ডা. গফুর বলেন, যারা এই ওষুধ কিনতে পারেন, তারা প্রায়ই তা অতিরিক্ত ব্যবহার করেন। আর যারা পারেন না, তারা চিকিৎসাই পান না।

তিনি বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনতে হলে প্রত্যেকটি প্রেসক্রিপশনে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বা মাইক্রোবায়োলজিস্টের দ্বিতীয় স্বাক্ষর থাকা উচিত।

গবেষকরা মনে করেন, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে স্মার্ট নীতি, নিয়ন্ত্রক তদারকি ও কার্যকর সাপ্লাই চেইন গড়ে তুলতে হবে। উদাহরণ হিসেবে কেরালার হাব-অ্যান্ড-স্পোক মডেলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে বড় হাসপাতালগুলো ছোট চিকিৎসাকেন্দ্রকে জটিল সংক্রমণ মোকাবেলায় সহায়তা করে।

নতুন অ্যান্টিবায়োটিক গবেষণার ক্ষেত্রে ভারতের ওষুধশিল্প এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মত গবেষকদের।

ডা. কন বলেন, ভারত নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের বড় বাজার হওয়ার পাশাপাশি, এই ওষুধের গবেষণা ও বিতরণে বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দিতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা টিকবে না। অস্ত্রোপচার, ক্যানসারের জটিলতা বা সাধারণ সংক্রমণ চিকিৎসার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলবে।

ডা. গফুর বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সতর্কতা জরুরি। কিন্তু তার চেয়েও জরুরি, যেন ওষুধ সঠিক ব্যক্তির কাছে ঠিকভাবে পৌঁছে।