ইরাবতীর প্রতিবেদন

রাখাইনে নতুন বাস্তবতা: আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগে বাংলাদেশ ও ভারত

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক সামরিক অগ্রগতির মাধ্যমে কার্যত সামরিক সরকারের বাহিনীকে উৎখাত করেছে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া রাখাইন অভিযান ইতোমধ্যে রাজ্যের ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ১৪টির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে এএ। সীমান্তবর্তী মংডু, বুথিডং এবং চিন রাজ্যের পালেতওয়া এলাকাসহ নাফ নদীঘেঁষা সম্পূর্ণ সীমান্ত এখন এএ-এর নিয়ন্ত্রণে।

এই ভূ-রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সীমান্তের বাস্তবতা স্বীকার করে উভয় দেশই এখন এএ-এর সঙ্গে যোগাযোগে আগ্রহী, যদিও কোনও রাষ্ট্রই এখনও এই সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। মিয়ানমার বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ইরাবতী এ খবর জানিয়েছে।

ইরাবতীর প্রতিবেদনে  বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, পশ্চিম সীমান্তে মিয়ানমার সরকারের আর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। সীমান্তজুড়ে এখন রাষ্ট্রবহির্ভূত গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ। আমাদের স্বার্থে যেকোনও পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা জরুরি।

বাংলাদেশ সরাসরি এএ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আর ভারত মিজোরাম রাজ্য সরকারের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মিজোরামে এএ একটি কার্যালয় খুলেছে বলেও খবর পাওয়া গেছে।

এএ মুখপাত্র খাইন থুখা বাংলাদেশের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।

মিয়ানমার জান্তা রাখাইনে কুখ্যাত ‘ফোর কাটস’ কৌশল অবলম্বন করছে। এই কৌশলের অংশ হিসেবে খাদ্য, অর্থ, তথ্য ও জনসমর্থন বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। চিকিৎসা সামগ্রী, জ্বালানি, পোশাক ও নির্মাণসামগ্রী নিষিদ্ধ হওয়ায় পণ্যের মূল্য দ্বিগুণ হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ও ভারত জান্তার চাপে সাড়া না দিয়ে সীমান্তে সীমিত বাণিজ্য চালু রেখেছে।

মিজোরামের সীমান্ত দিয়ে প্রতি বছর কয়েকশ কোটি কিয়াত মূল্যের পণ্য আদানপ্রদান হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সম্প্রদায়ের কারণে মাঝে মাঝে বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটে। বাংলাদেশের দিকেও সীমান্ত বাণিজ্য পুনরায় শুরু হয়েছে। যার ফলে ওষুধ ও খাদ্য সংকট অনেকটা প্রশমিত হয়েছে। এখন স্থানীয় কৃষিপণ্য ও সামুদ্রিক মাছও রফতানি করতে পারছেন রাখাইনবাসী।

বাংলাদেশের সরকারি উপদেষ্টারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে এএ-এর সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসও কক্সবাজার সফরের সময় এই অবস্থানকে সমর্থন করেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আনুষ্ঠানিকভাবে এএ-কে বাংলাদেশ স্বীকৃতি না দিলেও জাতীয় স্বার্থে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্ব স্বীকার করেছেন।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হোসেন বলেছেন, আমরা রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে চাই। এএ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে বলে আমরা আশ্বস্ত।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য রাখাইনে 'সেফ জোন' তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামি রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী রাখাইনে একটি স্বাধীন রোহিঙ্গা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবুও রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যের অন্যান্য বাসিন্দাদের সমান নাগরিক হিসেবে সম্পৃক্ত করাই তাদের প্রত্যাবাসনের পথ সুগম করতে পারে।

এদিকে, বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টারা জোর দিয়ে বলেছেন, শরণার্থী সংকট সমাধানে শুধু মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে নয়, আরাকান আর্মি (এএ) এবং জান্তাবিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি)-এর সঙ্গেও সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের এই নতুন কৌশলগত অবস্থান রাখাইন পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছে।

২০২৪ সালের শুরুর দিকে বুথিডংয়ে সংঘর্ষ শুরু হলে মুসলিম বিদ্রোহী সংগঠন আরসা, এআরএ এবং আরএসও জান্তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে এএ-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদের অবস্থান এখন সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে, যেখানে তারা অস্ত্র পাচার, মাদক ব্যবসা এবং জোরপূর্বক নিয়োগ চালিয়ে যাচ্ছে।

আরসা নেতা আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনিকে বাংলাদেশের র‍্যাব মার্চ মাসে গ্রেফতার করে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের স্পষ্ট বার্তা, এসব মুসলিম সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আর বরদাশত করা হবে না।

প্রাথমিকভাবে জাতিসংঘ প্রস্তাবিত রাখাইনের জন্য মানবিক সহায়তা করিডোর চালুর উদ্যোগে সমর্থন ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাপ্রধান এটিকে ‘ব্লাডি করিডোর’ আখ্যা দিয়ে বিরোধিতা করলে পরিকল্পনাটি স্থগিত হয়।

সরকার রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সচেষ্ট থাকলেও সেনাবাহিনী চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়তে অনিচ্ছুক। আগামী নির্বাচনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন হতে পারে, তবে সামরিক প্রভাব এতটাই দৃঢ় যে তা নাটকীয় পরিবর্তন নয়, বরং ধীরে ধীরে এগোবে বলে বিশ্লেষকদের মত।