দালাই লামার উত্তরসূরি, চীন-ভারত সংঘাত আর একটি সোনার কৌটো

তিব্বতিদের প্রধান ধর্মগুরু দালাই লামার উত্তরসূরি নির্বাচনের চরম বিতর্কিত বিষয়টিকে ঘিরে ভারত-চীন সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অথচ গত মে মাসে চারদিনের ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে চীন প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে বরফ গলতে শুরু করেছিল।

আসলে চীন প্রবলভাবে আগ্রহী তাদের নিজস্ব পছন্দে দালাই লামার একজন উত্তরসূরি নির্বাচনের জন্য।

দালাই লামার অনুগামীদের মধ্যে একটি প্রবাদ আছে, ‘যখন ছোট্ট ধর্মশালা নড়ে, তখন শক্তিশালী বেইজিং কেঁপে ওঠে’।

ভারতের হিমাচলে ছোট্ট শৈলশহর ধর্মশালাই হলো সেই ১৯৫৯ সাল থেকে দালাই লামার পীঠস্থান, যখন তিনি চীনের নিয়ন্ত্রণভুক্ত তিব্বত থেকে গোপনে ভারতে পালিয়ে এসে এ দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন। ভারতের ধর্মশালা হলো ‘প্রবাসী তিব্বত সরকারে’রও রাজধানী।  

এদিকে চলতি সপ্তাহেই সেই ধর্মশালা থেকেই ৯০ বছর বয়সী দালাই লামা ঘোষণা করেছেন, তার প্রতিষ্ঠিত ‘গাদেন ফোডরাং ট্রাস্ট’-ই কেবলমাত্র তার উত্তরসূরি নির্বাচনের একমাত্র অধিকারী — আর এতেই চীন অস্বস্তিতে পড়েছে।

বুধবার (২ জুলাই) ভারতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত শু ফেইহং এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন: ‘চীনের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতার নীতিতে বিশ্বাস করে। এটি জীবন্ত বৌদ্ধ গুরুদের পুনর্জন্মের ঐতিহ্যকে আইনের মাধ্যমে রক্ষা করে।’

তিনি আরও লিখেছেন: ‘দালাই লামার পুনরাবির্ভাবের ক্ষেত্রেও চীনের মধ্যেই অনুসন্ধান ও চিহ্নিতকরণ, সোনার কৌটোর (Golden Urn) মাধ্যমে নির্বাচনের পদ্ধতি অনুসরণ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বাধ্যতামূলক অনুমোদন—এটি ধর্মীয় আচার অনুযায়ী সম্পন্ন হতে হবে।’

এখন প্রশ্ন হলো, এই সোনার কৌটার মাধ্যমে নির্বাচনের পদ্ধতিটা ঠিক কী?

বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, ১৭৯২ সালে চীনের চিং রাজবংশ তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের বেছে নিতে এই পদ্ধতির শুরু করে। দালাই লামা বা তিব্বতিদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা পাঞ্চেন লামা কারা হবেন, সেটা স্থির করার জন্য মনোনীত প্রার্থীদের নাম কাগজে লিখে একটি সোনার কৌটায় রাখা হয়, তারপর সেখান থেকে লটারি করে চূড়ান্ত করা হত ধর্মগুরুদের নাম।

তিব্বতের রাজধানী লাসার একটি সংগ্রহশালায় চিং রাজাদের প্রবর্তিত সোনার কৌটার রেপ্লিকা

ধর্মগুরুদের নির্বাচনে কথিত দুর্নীতির অপসারণ এবং তিব্বতিদের ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই এই প্রথা শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু অনেক তিব্বত বিশেষজ্ঞই বলেন কালে কালে এ‌ কৌটোটি চীনের একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে– যে তিব্বতিদের ধর্মগুরু নির্বাচনেও শেষ কথা বেইজিং-ই বলবে!

কিন্তু লাখ লাখ যে তিব্বতি বহুদিন হলো চীনের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে এসে ভারতে বসবাস করছেন – তারা মনে করেন তাদের ধর্মগুরু নির্বাচনের অধিকার একান্তভাবেই তাদের, বেইজিং বা তার সোনার কৌটার এখানে কোনও ভূমিকাই থাকতে পারে না।   

১৪তম দালাই লামা তেনজিন গ্যৎসো, যিনি তিব্বতিদের কাছে সবচেয়ে সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, তিনিও তাই বেইজিংকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, ‘এই (উত্তরসূরি নির্বাচনের) বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার মতো কোনও কর্তৃত্ব অন্য কারও নেই।’

গাদেন ফোডরাং ট্রাস্ট-এর সদস্য সামধং রিনপোচে ধর্মশালায় মঙ্গলবার এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেছেন, ‘যখন সময় আসবে, তখনকার (পরবর্তী) দালাই লামা পুনর্জন্ম নেবেন। এবং যে কোনও লিঙ্গের ব্যক্তি (পুরুষ বা নারী) দালাই লামার পুনর্জন্ম হিসেবে স্বীকৃত হতে পারেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরবর্তী দালাই লামা যে তিব্বত থেকেই হতে হবে, তা আবশ্যক নয়।’

বিখ্যাত তিব্বত বিশেষজ্ঞ ও লেখক বিজয় ক্রান্তি, যিনি দালাই লামার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত, তিনি জানাচ্ছেন, ‘আসলে দালাই লামা নির্বাচনের এই প্রক্রিয়ায় সরাসরি হস্তক্ষেপ চীনের একটা বহুদিনের দাবি। তারা চায় তাদের নিজস্ব আইন অনুযায়ী পরবর্তী দালাই লামার নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতে, আর সেটা বর্তমান দালাই লামার সরাসরি বিরোধিতা করেন!’

বিজয় ক্রান্তি বলেছেন, ‘এটি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর নেতৃত্বের প্রতিও একটি চ্যালেঞ্জ। চীনের সর্বময় নেতা আসলে খুবই বিস্মিত যে গত সত্তর বছরে তিব্বতে ব্যাপক দমন-পীড়ন চালানো সত্ত্বেও, তিব্বতবাসীদের মানসিকতা, এমনকি তরুণ প্রজন্মের মনোভাবও খুব একটা বদলায়নি।’

প্রায় দীর্ঘ সাত দশক ধরে ভারতে তিব্বতিদের প্রধান ঠিকানা হল ধর্মশালা

এই মুহূর্তে দালাই লামা হিমাচল প্রদেশের অনিন্দ্যসুন্দর পাহাড়ি শহর ধর্মশালা ও লাগোয়া ম্যাকলিওডগঞ্জে তিব্বতি ধর্মীয় নেতাদের একটি তিনদিনের সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন। এই অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ঐক্য, আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ এবং বিশ্বশান্তি। বিভিন্ন তিব্বতি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের শীর্ষ সন্ন্যাসী ও পণ্ডিতেরা এতে অংশ নিচ্ছেন।

ধর্মশালা ১৯৫৯ সালে দালাই লামার তিব্বত থেকে পালিয়ে আসার পর থেকেই তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের সদর দফতর। ভারতে বসবাসকারী তিব্বতি সম্প্রদায় প্রায়শই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সভাগুলোর জন্য ধর্মশালাকে বেছে নেয়।

ভারত-চীন সম্পর্কে উত্তেজনার সম্ভাব্য কারণ

এই বিতর্কিত বিষয়টি ভারত ও চীনের মধ্যে আবারও উত্তেজনার শঙ্কা তৈরি করেছে। যদিও সম্প্রতি দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হতে দেখা গেছে। এমন কী, দীর্ঘ ছয় বছর পর এই গ্রীষ্মে ভারতের হিন্দু তীর্থযাত্রীরা চীনের তিব্বতে অবস্থিত কৈলাস মানসরোবরে যাওয়ারও অনুমতি পেয়েছেন।  

কিন্তু দালাই লামার উত্তরসূরি নির্বাচনের প্রশ্নটি আলাদা, আর খুবই স্পর্শকাতর। চীন তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে উত্তরসূরি নির্বাচনে অত্যন্ত আগ্রহী এবং শেষ পর্যন্ত একটি ‘দ্বৈত উত্তরসূরি’ পরিস্থিতি (মানে চীনেও একজন, ভারতেও একজন) তৈরি হলে ভারত সরকার কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, তা চীন খুব সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।

দালাই লামার উত্তরসূরি নির্বাচন বরাবরই বেইজিংয়ের জন্য একটি সংবেদনশীল বিষয়। এমনকি পঞ্চেন লামার বিষয়টিও, যিনি দালাই লামার পর তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হিসেবে বিবেচিত হন।

বর্তমান পঞ্চেন লামা, গেডুন চোয়েকি নিয়ামা, যাকে ১৯৯৫ সালে দালাই লামা স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, তাকে এরপরই চীন সরকার আটক করে এবং তখন থেকেই তিনি নিখোঁজ। চীন পরে নিজস্ব পছন্দে গিয়ানচেইন নরবু-কে পঞ্চেন লামা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, যা গোটা তিব্বতি বিশ্বজুড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

বেইজিংয়ের চায়না তিব্বতোলজি রিসার্চ সেন্টার, যারা চীনের তিব্বত নীতির মূল রূপকার, সেই ২০১৯ সালেই সতর্ক করে দিয়েছিল—চীনের প্রস্তাবিত সোনার কৌটো পদ্ধতির মাধ্যমে দালাই লামার নিয়োগ উপেক্ষা করলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।