রুশ সীমান্তে ন্যাটোর যুদ্ধজাহাজ আর কূটনীতি

'আমাদের জন্য অনেকেই রাতে ঘুমাতে পারেন না'। ন্যাটোর ক্ষমতা প্রসঙ্গে এমনটাই মনে করেন মার্কিন মেরিন কর্পস ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইমন ডোরান। মার্কিন প্রতিনিধি হিসেবে ব্রিটিশ কেরিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ ২১ (সিএসজি২১) প্রকল্পে কাজ করেন ডোরান। এই প্রকল্পটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজের দলের তালিকায় পঞ্চম।

বর্তমানে এই বিশাল আকারের জাহাজের দলটি যুক্তরাজ্যের দিকে ফিরছে। ফেরার আগে ৪০ হাজার নটিক্যাল মাইল পথ পেরিয়েছে তারা। সিএসজি২১ দলের একেবারে মাঝে রয়েছে এইচএমএস কুইন এলিজাবেথ জাহাজ।

সিএসজি ২১ তার যাত্রাপথে কখনও আইএস আবার কখনও চীনা সাবমেরিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সম্প্রতি কৃষ্ণ সাগরে মহড়া সেরে আসা এই জাহাজগুলো প্রয়োজনে যেকোনও স্থানে গিয়ে লড়তে প্রস্তুত, নিশ্চিত করলেন ডোরান।

তিনি বলেন, শুধু সম্ভাব্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তেই নয়, প্রয়োজনে আমাদের মিত্রদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারি আমরা। আমাদের বিমানবাহী জাহাজে রয়েছে বহু হালনাগাদ প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান। মূল জাহাজটি রয়েছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধজাহাজের চক্র দিয়ে ঘেরা। ফলে, এটা নিয়ে সবাই চিন্তিত।

জুন মাসে কৃষ্ণ সাগরে মহড়ার পর থেকেই সেখানে নতুন করে দানা বাঁধছে রুশ-ইউক্রেন চাপানউতোর। এই সংকটের প্রভাব পড়ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ন্যাটো ও মিত্রশক্তিগুলোর ওপরও।

পোলিশ প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদা সম্প্রতি বেলারুশ-পোলিশ সীমান্তে চলা অভিবাসী সংকটের সঙ্গে ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের সম্পৃক্ততা থাকার কথা বলেন। গত সপ্তাহে ন্যাটোর প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে তিনি আকাশপথে টহল আরও জোরদারের কথা বলেন। পাশাপাশি, ন্যাটো-সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পূর্বদিকে, অর্থাৎ পোলিশ-বেলারুশ সীমান্তের কাছে নজরদারি, সুরক্ষা ব্যবস্থা ও সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতি জোরদার করতেও আহ্বান জানিয়েছেন দুদা।

মঙ্গলবার ন্যাটো দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকেও প্রাধান্য পাবে এসব 'হাইভোল্টেজ' ইস্যু।

লাটভিয়ার রাজধানী রিগায় অনুষ্ঠিতব্য এই বৈঠকের বিষয়ে শনিবার কথা বলেন ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল ইয়েনস স্টোলটেনবের্গ। তিনি বলেন, এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো রাশিয়া এই অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করেছে। একইসঙ্গে প্রস্তুত করেছে ট্যাংক, ড্রোনসহ নানা অত্যাধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম।

ন্যাটোর সতর্কতার পরিণাম

স্টোলটেনবের্গের মতে, রাশিয়া যা করছে তার কোনও যৌক্তিকতা নেই। এতে শুধুই চাপ বাড়ছে। রাশিয়াকে সতর্ক করে তিনি বলেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিলে তার ফল ভোগ করতে হবে রাশিয়াকে।

কূটনীতির হিসেবে গোলমাল হলে অবশ্য রাশিয়াকে পিছু হটানোর বদলে ন্যাটোর যাতে কোনও ক্ষতি না হয়ে যায়, সে বিষয়েও সতর্ক এই জোট। যদিও ন্যাটো দেশগুলো একমত যে রাশিয়ার সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপ কোনোভাবে মেনে নেবে না তারা। কিন্তু বিষয়টি এতটা সহজ নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উচ্চপদস্থ ন্যাটো কর্মকর্তার ভাষায়, ‘আমরা যদি বলি যে রাশিয়া এমন কিছু করলে তার ফল ভোগ করতে হবে, সেক্ষেত্রে আমাদের আগে স্পষ্ট করে বলতে হবে যে সেই ফলাফলগুলো কী কী। অন্যদিকে, আমরা চাই না যে এমন কিছু করা হোক, যাতে যেদিকে ন্যাটো চায় এই পরিস্থিতি যাক, তার বদলে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি স্থানে গিয়ে বিষয়টি দাঁড়াক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে আমরা সঠিক দিকগুলো চিহ্নিত করবো এবং কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবো, যাতে পরিস্থিতি আরও জটিল না হয়ে সহজ হয়।’

কতদিন ঠেকানো যাবে সংকট?

ন্যাটোর কূটনীতিকরা যদিও এখন পর্যন্ত পরিস্থিতিকে তাদের পক্ষেই দেখছেন, কিন্তু ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। রাশিয়া ইতোমধ্যে সামরিক হাসপাতাল গড়া শুরু করেছে, যা বুঝিয়ে দিচ্ছে, সংঘর্ষ হয়তো আসন্ন।

বিশেষজ্ঞ লড়েন স্পেরানজার মতে, ন্যাটো চাইলে আরও জোরদারভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। পুতিনকে এখনকার চেয়ে বেশি চাপে রাখাও সম্ভব হতো। তার বক্তব্য, ‘রাশিয়ার হাইব্রিড প্রচারণা চারদিকে বিস্তৃত এবং কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখানোটাই যথেষ্ট নয়।’

রাশিয়াকে কড়া বার্তা দিতে ইইউ-এর আরও 'সংগঠিত প্রতিক্রিয়া' দেখানো উচিত বলে মনে করেন তিনি। সাইবার কূটনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক কূটনৈতিক চাপ এবং রুশ সম্পত্তি আটকে দেওয়ার মতো পন্থার সপক্ষে যুক্তি দেন তিনি।

আরেক বিশেষজ্ঞ অলগা লাউটমানের মতে, ন্যাটো দেশগুলোর নেতৃত্বের অবিলম্বে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসা করা বন্ধ করতে হবে। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্বের কাছে পুতিন একজন গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজিস্ট বা মহান কোনও রাজনৈতিক পরিচালক। কিন্তু আসলে তিনি তা নন। বর্তমানে পুতিন আমাদের পরীক্ষা করে দেখছেন আমরা আদৌ এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছি কিনা। একইসঙ্গে আমার ধারণা, পুতিন আসলে যাচাই করে দেখছেন যে কত দূর পর্যন্ত কোনও আপস বা বৈঠক না করেই তিনি এগিয়ে যেতে পারেন। এখনই সময় তাকে একা করে ফেলবার।’

ভবিষ্যৎ অস্পষ্ট হলেও এইচএমএস কুইন এলিজাবেথে থাকা ন্যাটো বাহিনী ক্রেমলিনের উদ্দেশে দৃঢ়ভাবে তাদের বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপে ন্যাটোর ডেপুটি সুপ্রিম অ্যালাইড কমান্ডার জেনারেল টিম রাডফোর্ডের মতে, ‘এই জাহাজ ও বিমান নিয়ে যে আমরা কৃষ্ণ সাগর পেরিয়ে এসেছি, সেটাই প্রমাণ করে দেয় যে ইউরো-আটলান্টিক অঞ্চলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে ন্যাটো। এই অঞ্চলে সার্বক্ষণিক নজরদারি চালাচ্ছি আমরা, তা সেটা উত্তর, দক্ষিণ যেকোনও প্রান্তেই হোক না কেন। এমনকি তা খোদ কৃষ্ণ সাগরে হলেও।’ সূত্র: ডিডব্লিউ।