রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ছড়াতে পারে ইউরোপের আরেকটি দেশে

রাশিয়ার একজন মন্ত্রী মলডোবার বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল ট্রান্সনিস্ট্রিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়টি উড়িয়ে দেননি। মঙ্গলবার অঞ্চলটিতে কয়েকটি বিস্ফোরণে উত্তেজনা বেড়েছে। মলডোবার প্রেসিডেন্ট দেশটির জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা। এমন পরিস্থিতিতে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে আরেকটি ইউরোপীয় দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও বেড়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এ খবর জানিয়েছে।

রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই রুডেঙ্কো মঙ্গলবার বলেছেন, ট্রান্সনিস্ট্রিয়াতে সর্বশেষ বিস্ফোরণে উদ্বিগ্ন মস্কো। ট্রান্সনিস্ট্রিয়াকে যুদ্ধে জড়ানো লাগে এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করবে রাশিয়া।

মস্কোতে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, অঞ্চলটিতে বিস্ফোরণ পরিস্থিতি ইঙ্গিত দেয় নির্দিষ্ট শক্তি এই হামলার নেপথ্যে রয়েছে। তারা ইউরোপে আরেকটি উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চল তৈরি করতে চায়।

রুশ মন্ত্রী আরও বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্ত করা হবে। আমরা আশা করি, বিস্ফোরণের কারণ জানা যাবে এবং জড়িতদের শাস্তি দেওয়া হবে।

ট্রান্সনিস্ট্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। অঞ্চলটিতে রাশিয়ার দেড় হাজার স্থায়ী সেনা রয়েছে। ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে রয়েছে বিশাল অস্ত্র গুদাম।

বিস্ফোরণের ঘটনায় মলডোবার প্রেসিডেন্ট মাইয়া সান্ডু মঙ্গলবার নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে বৈঠকের পর রুশ মন্ত্রী এসব কথা জানালেন।

মঙ্গলবার সকালে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানায়, রাশিয়ার রেডিও সম্প্রচারে ব্যবহৃত দুটি অ্যান্টেনা বিস্ফোরিত হয়েছে। এর আগে সোমবার অজ্ঞাত হামলাকারীরা অঞ্চলটির টিরাসপোলে নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ে গোলাবর্ষণ করে।

নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের পর মলডোবার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার নির্দিষ্ট অজ্ঞাত শক্তি যুদ্ধের পক্ষের এবং অঞ্চলটিতে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে দিতে চায়।

এর আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ট্রান্সনিস্ট্রিয়াতে বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনি উদ্বিগ্ন। আর স্বঘোষিত প্রজাতন্ত্র ডনেস্ক’র নেতা ডেনিস পুশিলিন বলেছেন, পরের ধাপের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনার সময় রাশিয়া উচিত ট্রান্সনিস্ট্রিয়াতে যা ঘটছে তাতে মনোযোগ দেওয়া।

গত সপ্তাহে এক সিনিয়র রুশ কমান্ডার বলেছিলেন, ইউক্রেনে আক্রমণে রাশিয়ার নতুন লক্ষ্য হলো দক্ষিণ ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এবং ট্রান্সনিস্ট্রিয়া যাতায়াতের পথ প্রতিষ্ঠা করা। তার এই বক্তব্যের পরই উদ্বেগ ছড়ায় পূর্ব ইউরোপের ছোট দেশ মলডোবা হয়ত পশ্চিমা ও মস্কোর মধ্যকার উত্তেজনার নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।

নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ে বিস্ফোরণের বিষয়ে মলডোবার সরকার জানায়, এই বিস্ফোরণ বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলে নিরাপত্তা পরিস্থিতি অবনতি বলে তুলে ধরার পটভূতি তৈরির লক্ষ্যে ঘটানো হয়েছে।

মঙ্গলবার ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার কর্মকর্তারা বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেন। এতে বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলে সম্ভাব্য উত্তেজনার আশঙ্কা আরও বেড়েছে। তাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে, অঞ্চলজুড়ে শহরের প্রবেশ মুখে সামরিক চেকপয়েন্ট স্থাপন এবং ৯মে বিজয় দিবসের বার্ষিক প্যারেড বাতিল।

ট্রান্সনিস্ট্রিয়ায় বিধ্বস্ত রেডিও টাওয়ার

থিংক ট্যাংক ক্লিঙ্গেনডায়েল ইন্সটিটিউটের মলডোবা বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো বব ডিন জানান, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো রাশিয়া কর্তৃক সাজানো নাকি রুশ-বিরোধী গোষ্ঠীর প্রকৃত নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড, তা জানা কঠিন।

কিন্তু বব ডিন বলছেন, রাশিয়ার সাম্প্রতিক বাগাড়ম্বর ট্রান্সনিস্ট্রিয়াতে তাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা দেখছি রাশিয়ায় প্রকাশ্যে ট্রান্সনিস্ট্রিয়াকে নিয়ে আলোচনা বেড়েছে। দেশটির সাম্প্রতিক বক্তব্য অঞ্চলটিতে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত হতে পারে।

ডিনের মতে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় ডনবাসে তুমুল লড়াইয়ে লিপ্ত থাকার কারণে রুশ সেনাদের পক্ষ মলডোবার সীমান্তে আক্রমণের সুযোগ কম। ট্রান্সনিস্ট্রিয়া পৌঁছাতে হলে মস্কোকে ওডেসায় আক্রমণ করতে হবে। সম্প্রতি যুদ্ধজাহাজ মস্কোভা ডুবির পর ওডেসায় রুশ আক্রমণ থমকে আছে। ওই ঘটনায় ইউক্রেন উপকূল থেকে দূরে সরে গেছে রুশ যুদ্ধজাহাজ।

ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী যোদ্ধাদের নিয়েও সন্দিহান ডিন। তাদের প্রায় সাড়ে ৭ হাজার যোদ্ধা রয়েছে। তিনি মনে করেন না যে পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত দিয়ে ইউক্রেনে হামলায় এসব যোদ্ধাদের ব্যবহার করবে রাশিয়া।

এই গবেষক বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ নিয়ে ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার জনগণ ও যোদ্ধাদের মধ্যে সমর্থন খুব বেশি নেই। অনেকেই সহিংসতা এড়াতে মলডোবার দিকে এগোচ্ছেন। বেলারুশও এই যুদ্ধে পুরোপুরি জড়াতে চায় না।

তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছেন, রাশিয়ার সাম্প্রতিক বাগাড়ম্বর হয়ত ডনবাস থেকে পশ্চিম সীমান্তে ইউক্রেনীয় সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য কৌশল হতে পারে।

১৯৯০ দশকে রাশিয়ার সহযোগিতায় মলডোবার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে ট্রান্সনিস্ট্রিয়া। এই যুদ্ধের পর তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এবং রাশিয়ার সেনাদের স্থায়ী ঘাঁটি গড়ে উঠেছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম বহুল প্রচায় হয় অঞ্চলটিতে। যা রুশপন্থী মনোভাব গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি মলডোবা ও পশ্চিমাবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিও গড়ে উঠেছে।

গত সপ্তাহে মলডোবার প্রেসিডেন্ট সান্ডু একটি আইনে স্বাক্ষর করেছেন, যাতে কমলা ও কালো রঙে ডোরাকাট সেন্ট জর্জের রিবন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই চিহ্ন সরকার ও সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের সমর্থন প্রকাশে জন্য রাশিয়াতে তুমুল জনপ্রিয়। একই আইনে সান্ডু যুদ্ধের সমর্থনে ‘জেড’ এবং ‘ভি’ চিহ্ন নিষিদ্ধ করেছেন। যা প্রথমে রাশিয়ার সশস্ত্রবাহিনী ব্যবহার করেছিল।