রুশ টেলিভিশনে কীভাবে তুলে ধরা হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ?

দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পাল্টা আক্রমণের মঞ্চ প্রস্তুত করছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী। এমন সময় মস্কোর পণ্ডিতবর্গ আশাবাদী হওয়ার মতো কোনও উপলক্ষ খুঁজে পাচ্ছে না। ইউক্রেনে রাশিয়াত কথিত ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ এখনও পরিকল্পনামতো চলছে বলে দাবি করা থেকে সরে এসে ক্রেমলিন নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম সক্রিয়ভাবে দেশটির জনগণকে প্রস্তুত করছে রণক্ষেত্রে আরও ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার জন্য। মার্কিন সাময়িকী নিউজউইকের এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার-এর ক্যাটেরিনা স্টেপানেঙ্কো বলেন, ইউক্রেন পশ্চিমা যেসব অস্ত্র পাচ্ছে তা রাশিয়ার কেন্দ্রীয় টক শো এবং সংবাদ সম্প্রচারে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হচ্ছে। তারা প্রকৃতপক্ষে ন্যাটো দেশগুলোতে প্রশিক্ষণ নেওয়া ইউক্রেনীয় সেনাদের সংখ্যা এবং পশ্চিমা অস্ত্রের পরিমাণকে হাইলাইট করছে।

রুশ দর্শকদের ক্রেমলিন অনুমোদিত অবস্থান ও বার্তা একটি ইঙ্গিত তুলে ধরছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে খারকিভ ও নভেম্বরে খেরসনে ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণের সাফল্যের পর মস্কো আশঙ্কা করছে চলতি গ্রীষ্মে ইউক্রেন মেলিতোপোল, বারদিয়ানস্ক ও এমন কী ক্রিমিয়ার ভূখণ্ডও পুনরুদ্ধার করতে পারে।

স্টেপানেঙ্কো বলেন, রাশিয়ার টেলিভিশনে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণে কোথায় মনোযোগ দিতে পারে। তারা ইউক্রেনের গোয়েন্দা ড্রোন নিয়ে কথা বলছে, সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে পাওয়া স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে লুহানস্কে ইউক্রেনীয় হামলার ফুটেজ বারবার প্রদর্শন করা হচ্ছে। তারা ক্রিমিয়া যে হুমকির মুখে তা গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরছে। ন্যাটো ও কিয়েভের তথাকথিত নাৎসিদের নিয়ে রুশদের ভয় নিয়ে আক্রমণাত্মক ইঙ্গিত দিচ্ছে।

অবশ্য রুশ সংবাদমাধ্যমে একেবারেই যে আশার কোনও আলোর কথা তুলে ধরা হচ্ছে না, তা নয়।

স্টেপানেঙ্কো ব্যাখ্যা করে বলেন, একই সময়ে তারা হুমকিকে বড় করে তুলে ধরছে। গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জনের জন্য ইউক্রেনের সামর্থ্য কমিয়ে দিতে রাশিয়া নেওয়া পদক্ষেপের বিষয়ও তুলে ধরা হচ্ছে। তারা বারবার রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফুটেজ দেখাচ্ছে। যে হামলার পর রাশিয়া দাবি করেছে ইউক্রেনীয় একটি সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। তারা দর্শকদের বলছে, এই হামলা ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণকে অন্তত পিছিয়ে দিয়েছে।

তিনি বলেন, যদি ইউক্রেন সাফল্য না পায় তাহলে ক্রেমলিনের প্রোপাগান্ডায় বলা যাবে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সঠিক ছিল এবং তাদের রক্ষণাত্মক প্রস্তুতির কারণে ইউক্রেন ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু যদি রুশ সেনাবাহিনী ইউক্রেনীয় হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়, যতক্ষণ না এই ব্যর্থতা বিপর্যয়কর হচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত খারকিভের চেয়ে বেশি বিস্মিত হবে না।

নিউজউইকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রেমলিন নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া ব্যবস্থা যেভাবে কাজ করে তা অনুসারে রুশ টেলিভিশনে এমন বার্তা কর্তৃপক্ষের সম্মতি ছাড়া সম্প্রচারিত হওয়ার সুযোগ নেই। নিয়মিত যুদ্ধংদেহী টক শোর বদলে এখন রুশ টেলিভিশনে ইউক্রেনকে রাশিয়ার বৈধ সামরিক হুমকি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। অথচ কিছু দিন আগেও টেলিভিশনগুলোতে এমন ধারণা ছড়ানো হতো যে, মস্কো সত্যিকার অর্থে চাইলে তিন দিনের মধ্যে কিয়েভ দখল করতে পারবে। সচেতনভাবে এমন ধারণা দর্শকদের মধ্যে ছড়ানো হয়।

রাশিয়ার কেন্দ্রীয় টেলিভিশনগুলোর টক শোতে এক সময় নিয়মিত উপস্থিত হওয়া রুশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিখাইল সিনেলনিকভ-ওরিশাক বলেন, কেউ যাতে অপ্রত্যাশিত কিছু বলতে না পারে সেজন্য আগে থেকেই মন্তব্য যাচাই-বাছাই করা হয়। তারা এখনও ইতিবাচক বিবৃতি নিয়ে কথা বলছে, কিন্তু সমস্যা গভীরে গিয়ে পর্যালোচনা করতে পারে এমন কাউকে স্টুডিওতে আমন্ত্রণ জানানো হয় না।

তিনি বলেন, কট্টর দেশপ্রেমিকরাও স্বীকার করছেন ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণ কিছু মাত্রায় সাফল্য পেতে পারে। কিন্তু দর্শকদের কাছে যে চিত্র তারা তুলে ধরছেন সেটি হলো, এমন কিছুর পরও তা রাশিয়ার যুদ্ধের উদ্যোগের জন্য খুব হুমকিজনক কিছু হবে না। তারা দাবি করছেন, ইউক্রেন নিজের সম্ভাব্য সাফল্য সম্পর্কে অতিরঞ্জিত প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলো একপ্রকার মানসিক থেরাপি সেশনে পরিণত হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এমনকি রাশিয়া যদি ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সীমান্ত পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয় তাহলেও দাবি করা হবে ইউক্রেনকে নিরস্ত্র এবং রুশ ভূখণ্ডে বড় হামলা শুরু করা থেকে তাদের বিরত রাখা হয়েছে।

সিনেলনিকভ-ওরিশাক বলেন, ইউক্রেনের কাছে রুশ সেনারা বড় ধরনের ব্যর্থতার শিকার না হলে বেশিরভাগ রুশ নাগরিক মেনে এই আক্রমণ প্রয়োজনীয় ছিল।