যুদ্ধের আগুনে ছারখার ইউক্রেনীয়দের জীবন

ছেলের ঘরে ফেরার প্রহর গুনছেন বাবা-মা। সধবারা বিধবা হয়েছে। শ্রেণিকক্ষগুলো ফাঁকা। জমিতে কাজ করার জন্য শ্রমিক পাচ্ছেন না কৃষকরা। বন্ধুরা চলে গেছে বা মরে গেছে। অপরিচিতরা আত্মীয় হয়ে গেছে। বর্তমান ইউক্রেনের চিত্র এখন এটাই। দুই বছরের যুদ্ধের চিহ্ন দেশটির সর্বত্রই ছড়ানো-ছিটানো। দেশটির আগের সেই চেহারাই পাল্টে গেছে। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরের গ্রামগুলোর চিত্রও একই রকম।

ফ্রন্টলাইন থেকে প্রায় এক শ’ কিলোমিটার দূরে লোজুভাটকা গ্রাম। এই তীব্র শীতে গ্রামের এক বিধবা অ্যালোনা ওনিশচুক, তার পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন সমাধিতে; যেখানে আরও ১০ সেনার সঙ্গে চির নিন্দ্রায় শায়িত তার স্বামী সের্হি অ্যালোশকিন। তার ৩৮ বছর বয়সী স্বামী ২০২২ সালের শেষের দিকে পূর্বাঞ্চলীয় শহর বাখমুতের কাছে লড়াই করার সময় নিহত হন।

দেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত এই গ্রাম থেকে অনেকটাই দূরে ইউক্রেনের পূর্ব এবং দক্ষিণ ফ্রন্ট। অথচ লড়াইয়ের আঁচ এসে এখানকার ছয় হাজার আটশ মানুষের গায়েও লেগেছে। এখানেই দেয়াল ঘেরা এক বাগানে এখন সারি সারি সমাধি। সদ্য খনন করা মাটিতে কাঠের ক্রস, মৃতদের ছবি, ফুল আর হলুদ-নীল রঙের ইউক্রেনের পতাকা এখনও জ্বলজ্বল করছে।  

ইউক্রেনজুড়েই এখন এ ধরনের সমাধিক্ষেত্র চোখে পড়ে, যা রুশ আগ্রাসনের ভয়াবহ চিহ্ন বহন করে চলছে। ভয়ংকর এই যুদ্ধ এখন তৃতীয় বছরে প্রবেশ করছে, যার আসলে কোনও শেষ আছে কি?

ইউক্রেনের সামরিক হতাহতের পরিসংখ্যানটি রাষ্ট্রীয়ভাবে গোপনীয়। তারপরও পশ্চিমাদের ধারণা, যুদ্ধে কয়েক হাজার সেনা নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও কয়েক হাজার। এই দুই বছরে রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে অভিযান শুরু করে পুতিনের সেনাবাহিনী।  

যদিও গ্রামে সরাসরি রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা বিরল। তারপরও ইস্পাত-উৎপাদনকারী শহর ক্রিভি রিহের কাছাকাছি হওয়ায়, যুদ্ধের সাইরেনে কান ঝালাপালা গ্রামবাসীর। কারণ ওই শহরটি প্রায়ই আক্রান্ত হয়। 

ফলে লোজুভাটকার তিনটি স্কুলের সবগুলোই প্রায় ফাঁকা পড়ে আছে। তবে সেখানে অনলাইনে ক্লাস চলে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা যদিও ১০/১১ জনের বেশি না।   

আগস্টে, জাতিসংঘের শিশু তহবিল-ইউনিসেফ জানিয়েছিল, ইউক্রেনজুড়ে স্কুল-বয়সী শিশুদের এক-তৃতীয়াংশ সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগতভাবে ক্লাসে অংশ নেয়। কারণ দেশের সরকার-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ১ হাজার ৩০০টির বেশি স্কুল সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে।

লোজুভাটকার তিনটি স্কুলের একটির প্রধান শিক্ষক ইরিনা পোটোটস্কা জানিয়েছেন, স্কুলের ১৩৬ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪০ জনের বাবা বা অভিভাবক বর্তমানে সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। তবে স্কুল ভবনটিকে কাজে লাগানো হয়। এই ভবনে পোটোটস্কা অন্য নারীদের সঙ্গে খাবার ও পানীয় প্যাকেটজাত করার কাজে সাহায্য করেন। তাছাড়া সেনাবাহিনীর কাছে যেসব সাহায্য পাঠানো হয়, সেগুলোও এখানেই প্যাকেট ভর্তি করা হয়।

এখানেই সেনা ও সাধারণ নাগরিকদের জন্য কাজ করতে করতে অনেকের সঙ্গে পরিচিত হন তারা। অনেকের বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজন মারা গেছেন। আবার কেউ এ ধরনের কাজে আসতে চায় না। এই স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের সঙ্গ পরিত্যাগ করেছেন। তবে কাজ করতে করতে অপরিচিত অনেকেই আবার তাদের বন্ধু বা আত্মীয় হয়ে উঠেছেন।

নিহতের পাশাপাশি অনেক সেনা নিখোঁজও রয়েছেন। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত আট হাজার সেনা ও বেসামরিক নাগরিক রুশ সেনাদের হাতে বন্দি হয়েছেন। বন্দি বিনিময়ের অংশ হিসেবে প্রায় তিন হাজার মানুষ, যাদের বেশিরভাগই সেনা, মুক্তি পেয়েছেন। তবে এখনও অনেক পরিবার তাদের বন্দি আত্মীয়দের ভাগ্য নিয়ে চিন্তা করা ছেড়ে দিয়েছেন। 

তবে লোজুভাটকার বাসিন্দা তেতিয়ানা টেরলেটস্কা এবং ইউরি টেরলেটস্কি, তাদের ২৯ বছর বয়সী ছেলের প্রতীক্ষায় অপেক্ষার প্রহর গুনছেন এখনও। তাদের বিশ্বাস, তাদের ছেলে ফিরে আসবেন। ২০২১ সালে তাদের ছেলে ন্যাশনাল গার্ডে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। আর ২০২২ সালের মে মাসে দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনীয় বন্দর শহর মারিউপোলে যুদ্ধ করার সময় রুশদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন। তবে এখন এই ২০২৪ সালেও ছেলের কোনও খবর না পেয়ে প্রায় ভেঙেই পড়েছেন তারা।

এই গ্রামের একটি খামারের মালিক ওলেক্সান্ডার ভাসিলচেঙ্কো। তার খামারের বেশিরভাগ কর্মী সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। তাদের অনেকেই মারাও গেছেন। আরও কর্মী সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন বলে উদ্বিগ্ন তিনি। কারণ কিছুদিন পরই সূর্যমুখী, গম আর বার্লি কাটার মৌসুম শুরু হবে। তখন কী করবেন তিনি?

ইউক্রেনের অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষি। অথচ লোজুভাটকার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি দক্ষ খামার কর্মী সামরিক বাহিনীতে যোগদান করায়, কৃষির ওপর যুদ্ধের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।

৪২ বছর বয়সী ভাসিলচেঙ্কো জানিয়েছেন, কর্মীর পাশাপাশি কৃষি যন্ত্রপাতিরও অভাব দেখা দিয়েছে। যন্ত্রপাতি মেরামত আর নতুন কর্মী প্রশিক্ষণে সময় লাগবে। আর ততদিনে হয়ত তার অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যাবে। তার ওপর ইউক্রেন যদি আরও সেনা নিয়োগ করে, তাহলে তাদের কৃষি খাত প্রায় ধ্বংসই হয়ে যাবে।

বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় কমিশন এবং ইউক্রেনীয় সরকারের যৌথ সমীক্ষা অনুসারে, যুদ্ধের ফলে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে অন্তত ৩০ লাখ ৭০ হাজার মানুষ। আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দ্বারে দ্বারে আশ্রয় চাইছেন আরও ৫০ লাখ ৯০ হাজার ইউক্রেনবাসী। 

এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত? লোজুভাটকার ২৩ বছর বয়সী আনাস্তাসিয়া বলেন, লুহানস্ক, ডনেস্ক ও ক্রিমিয়ার জন্য আমার প্রাণ কাঁদে। কারণ ওগুলো আমাদের অঞ্চল। সেখানে আমাদের লোকেরা বাস করেন। তাই তার মতে, আমাদের হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের লড়াই চালিয়ে যাওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন আনাস্তাসিয়া।

সূত্র: রয়টার্স