রাশিয়ার সঙ্গে প্রায় তিন বছরের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটানোর লক্ষ্যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ‘বিজয় পরিকল্পনা’ নিয়ে পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। দেশটির ন্যাটোতে যোগদানের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ এবং রাশিয়ার সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে পশ্চিমা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি অন্তর্ভুক্ত থাকায় এই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে মিত্ররা এমন পদক্ষেপ নিতে এখনও দ্বিধান্বিত। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি এ খবর জানিয়েছে।
জেলেনস্কির প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নে অন্যান্য মিত্রদের সমর্থন পেতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী ৫ নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত আসা কঠিন। কারণ এটি ভোটারদের আকৃষ্ট নাও করতে পারে।
স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক ফিলিপস ও’ব্রায়েন বলেন, তারা খুব বেশি কিছু করছে না এবং নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। জেলেনস্কির পরিকল্পনার টিকে থাকা বা বাতিল হওয়ার ঘটনা ঘটবে ওয়াশিংটনে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিকল্পনা ইউক্রেনের সামরিক প্রচেষ্টার জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। যদিও এটি বেশ উচ্চাভিলাষী। কারণ মিত্ররা পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাশিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা বাড়াতে নারাজ। এর আগে ইউক্রেন যেসব সামরিক সহযোগিতা পেতে সক্ষম হয়েছে, যেমন প্যাট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং এফ-১৬ যুদ্ধবিমান, সেগুলোও একসময় অবাস্তব বলে বিবেচিত হয়েছিল।
জেলেনস্কি ইউরোপীয় কাউন্সিলের কাছে তার বক্তব্য পেশ করার পর দেশে ফিরে বলেছেন, তিনি আশা করেন হোয়াইট হাউজ থেকে শিগগিরই প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে।
পরিকল্পনাটি কি ইউক্রেনের জন্য বিজয় আনবে?
ইউক্রেনের সেনারা পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার ধীরগতির কিন্তু স্থিতিশীল অগ্রগতি রুখতে লড়ছে তখন পাঁচ দফার পরিকল্পনাটি তুলে ধরেন জেলেনস্কি। এতে তিনটি গোপন সংযোজন রয়েছে যা কেবল কয়েকজন নেতার কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া, ২০২৩ সালের ব্যর্থ গ্রীষ্মকালীন পাল্টা আক্রমণের পর ইউক্রেনের কৌশল নিয়ে মিত্রদের উদ্বেগও এতে সমাধান করার চেষ্টা করা হয়েছে।
জেলেনস্কি এই পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্যকে বর্ণনা করেছেন, আমাদের শক্তিশালী করা এবং সব মিত্রদের সঙ্গে রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা।
পরিকল্পনাটি যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতিকে তাৎক্ষণিকভাবে বদলে দেবে না, তবে এটি ইউক্রেনকে রাশিয়াকে চাপে রাখতে এবং যুদ্ধে টিকে থাকার আরও উপায় দিতে সহায়তা করবে।
সিবিলাইন নামক একটি কৌশলগত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং সাবেক ব্রিটিশ ট্যাংক কমান্ডার জাস্টিন ক্রাম্প বলেন, মানুষ সম্ভবত আরও অভিজানিক পরিকল্পনা প্রত্যাশা করেছিল, যেটি হবে যুদ্ধ জয়ের কৌশল। তবে শত্রুরা তা জানতে পারবে এমন বিবরণ প্রত্যাশা করা কিছুটা নৈর্ব্যক্তিক ছিল।
কিছু ইউক্রেনীয় বিশ্লেষক পরিকল্পনার নামকরণ নিয়ে অভিযোগ করেছেন, যা সম্ভবত প্রচারণামূলক উদ্দেশ্যে নির্বাচিত হয়েছে। ইউক্রেনীয় বিশ্লেষক ইউরি বগদান বলেন, এর মূল লক্ষ্য হলো সরঞ্জাম সংগ্রহ করা।
ইউক্রেনের থিংক ট্যাংক কাম ব্যাক অ্যালাইভ ইনিশিয়েটিভস সেন্টারের একজন বিশ্লেষক গ্লিব ভোলস্কি বলেন, এমন একটি যুদ্ধ জিততে ইউক্রেনকে তার সহনশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দিতে হবে। যে পক্ষ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে, সে-ই জিতবে।
মিত্রদের প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ছিল নীরব ও অস্পষ্ট। যদিও জেলেনস্কির পরিকল্পনা উপস্থাপনের দিনই তারা ইউক্রেনের জন্য ৪২৫ মিলিয়ন ডলারের নতুন একটি নিরাপত্তা সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন বলেন, জেলেনস্কির পরিকল্পনা প্রকাশ্যে মূল্যায়ন করা আমার দায়িত্ব নয়। আমরা তাকে আড়াই বছর ধরে নিরাপত্তা সহায়তা প্রদান করে আসছি। আমরা এটি চালিয়ে যাব।
ইউরোপে প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ছিল। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-নোয়েল বারো কিয়েভে শনিবার বলেন, তিনি ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ করবেন অন্যান্য দেশগুলোর সমর্থন আদায়ের জন্য।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস কিয়েভে টরাস দীর্ঘপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে তার অস্বীকৃতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেছেন, আমাদের অবস্থান পরিষ্কার: আমরা যতটা সম্ভব ইউক্রেনকে সমর্থন করছি। একই সঙ্গে আমরা নিশ্চিত করছি ন্যাটো যেন যুদ্ধে জড়িত না হয়।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের মধ্যে উষ্ণতম সম্পর্ক থাকা হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান ফেসবুক পোস্টে জেলেনস্কির পরিকল্পনাকে ‘ভীতিপ্রদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জেলেনস্কির পরিকল্পনাকে ‘অবাস্তব’ বলে বিদ্রূপ করেছেন এবং রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এটিকে ‘অসঙ্গতিপূর্ণ স্লোগানের সমষ্টি’ বলে মন্তব্য করেছেন।
ইউক্রেনের জন্য কী ঝুঁকি রয়েছে?
ন্যাটোর সদস্যপদ না পেলে ইউক্রেনের ভূরাজনৈতিক ভবিষ্যৎ রাশিয়ার সঙ্গে দর কষাকষির ক্ষেত্রে একটি তুচ্ছ বিষয় হয়ে পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষক ভোলস্কি।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য ইউক্রেনের জন্য ন্যাটো ছাড়া আর কোনও নিশ্চয়তা নেই। জেলেনস্কি পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে দ্ব্যর্থপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। যা অনেককে ভাবিয়েছে তিনি স্ব-নির্মিত পারমাণবিক অস্ত্রের কথা বলছেন। তবে পরে তিনি ১৯৯৪ সালের বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডামকে উল্লেখ করে এই মন্তব্যের ব্যাখ্যা দেন।
পশ্চিমা সমর্থন ছাড়া রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরান ও চীনের সহযোগিতায় পরিচালিত দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মুখে ইউক্রেনকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। ও’ব্রায়েন বলেন, বাইরের সাহায্য পাওয়া এই যুদ্ধ জয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।