২০২২ সালের রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি আলোচনা কেন ভেস্তে গিয়েছিল?

দীর্ঘদিন পর রাশিয়া ও ইউক্রেন নতুন করে শান্তি আলোচনায় বসতে পারে—এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবে এটি প্রথমবার নয়। ২০২২ সালের যুদ্ধের শুরুর দিকে দু’পক্ষ শান্তিপূর্ণ সমাধানে বসেছিল। কিন্তু সেই আলোচনাগুলো শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কী ছিল তখনকার আলোচনার বিষয়, কোন পয়েন্টগুলোতে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং কেন ভেঙে পড়েছিল এই প্রচেষ্টা—তা আবারও আলোচনায় এসেছে।

কোথায় ও কবে হয়েছিল আলোচনা?

রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের মাত্র চার দিন পর, ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বেলারুশে প্রথম বৈঠকে বসে রুশ ও ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিরা। এরপর একাধিক ভার্চুয়াল বৈঠক হয় এবং ২৯ মার্চ তুরস্কের ইস্তাম্বুলে দ্বিতীয় সরাসরি বৈঠক হয়।

দুই পক্ষ এরপর একাধিক খসড়া দলিল বিনিময় করে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। কিন্তু সেগুলো আর চূড়ান্ত রূপ পায়নি।

কী ছিল আলোচনার মূল বিষয়বস্তু?

নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রকাশিত খসড়া অনুযায়ী, ইউক্রেন একটি স্থায়ীভাবে নিরপেক্ষ, অ-জোটভুক্ত ও পারমাণবিক নিরস্ত্র রাষ্ট্র হওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল। এতে তাদের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পথ বন্ধ থাকত, তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের সুযোগ থাকত।

এর বিনিময়ে যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সসহ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যসহ কিছু দেশ ইউক্রেনকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা বলেছিল।

একটি আংশিকভাবে সম্মত খসড়ায় বলা হয়, এই নিশ্চয়তা দেওয়া রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে সম্মান করবে এবং বলপ্রয়োগ বা হুমকি থেকে বিরত থাকবে।

ক্রিমিয়া ইস্যুতে ১০-১৫ বছরের মধ্যে আলাদা আলোচনার প্রস্তাবও ছিল, যা ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়ার দখলে।

মতবিরোধের বিষয়গুলো কী ছিল?

নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিয়ে বিরোধ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেন চেয়েছিল, গ্যারান্টার রাষ্ট্রগুলো তাদের আকাশসীমা রক্ষায়, অস্ত্র সরবরাহে এবং সামরিক সহায়তায় সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। কিন্তু রাশিয়া বলেছিল, প্রতিটি পদক্ষেপে সব গ্যারান্টারের সম্মতি লাগবে—মানে, রাশিয়া কার্যত ভেটো দিতে পারবে।

সেনাবাহিনীর আকার ও অস্ত্রভাণ্ডার নিয়েও দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ইউক্রেন ২ লাখ ৫০ হাজার সেনা, ৮০০ ট্যাংক এবং সর্বোচ্চ ২৮০ কিমি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সীমা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু রাশিয়া তা কমিয়ে ৮৫ হাজার সেনা, ৩৪২ ট্যাংক এবং মাত্র ৪০ কিমি রেঞ্জ চাচ্ছিল।

ভাষা ও আইনের প্রশ্নেও বিরোধ দেখা দিয়েছিল। রাশিয়া চেয়েছিল, রুশ ভাষাকে ইউক্রেনের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হোক এবং রুশভাষীদের ‘বৈষম্য’ বন্ধ করা হোক—যা ইউক্রেন বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।

রাশিয়া ইউক্রেনের কিছু আইনকে নাৎসিবাদ ও নাৎসি মহিমান্বিত করার উদ্যোগ হিসেবে উল্লেখ করে বাতিলের দাবি তোলে। ইউক্রেন তা পুরোপুরি অযৌক্তিক বলে প্রত্যাখ্যান করে।

আলোচনা ভেঙে পড়ার পেছনে কারণ কী ছিল?

২০২২ সালের এপ্রিল নাগাদ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিস্থিতি ইউক্রেনের পক্ষে মোড় নিতে শুরু করে। রুশ বাহিনী কিয়েভ থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তোলে, যা আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হয়। যদিও মস্কো এসব অস্বীকার করে।

একই সময়ে পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে ব্যাপক সামরিক সহায়তা দিতে শুরু করে এবং রাশিয়ার ওপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ অবস্থায় ইউক্রেনের পক্ষ থেকে আলোচনায় নমনীয় হওয়ার আগ্রহ কমে যায় বলে মনে করেন গবেষক সের্গেই রাদচেঙ্কো ও বিশ্লেষক স্যামুয়েল চরাপ। ফরেন অ্যাফেয়ার্স সাময়িকীতে এই বিষয়ে তারা বিশদ বিশ্লেষণ করেছেন।

২০২২ সালের খসড়া কি এখনও প্রাসঙ্গিক?

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বলেন, ‘ইস্তাম্বুল প্রোটোকল’ এখনও আলোচনার ‘গাইডপোস্ট’ হিসেবে কাজ করতে পারে।

রুশ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিনের এক উপদেষ্টা রবির জানিয়েছেন, যে কোনও সম্ভাব্য নতুন আলোচনায় ২০২২ সালের আলোচনাকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় রাখতে হবে।

তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বলেন, ‘ইস্তাম্বুল চুক্তি’ বলে কিছু নেই। বরং ইউক্রেন রাশিয়ার একটি ‘আল্টিমেটাম’-এর জবাব দিয়েছিল, কোনও দলিলে স্বাক্ষর করা হয়নি।

২০২২ সালে আলোচনা যতটা না সার্বভৌমত্ব নিয়ে ছিল, বর্তমানে তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ভূখণ্ড ইস্যু। ২০২৪ সালের জুনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন, ইউক্রেনকে ডনেস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিজ্জিয়া ও খেরসন অঞ্চলগুলো থেকে পুরোপুরি সরে যেতে হবে। এই চার অঞ্চল রাশিয়া নিজেদের দাবি করে, যদিও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।

ইউক্রেন বলেছে, তারা রুশ দখলকে কখনও বৈধতা দেবে না। তবে জেলেনস্কি স্বীকার করেছেন, এখনই সব ভূখণ্ড উদ্ধার সম্ভব নয় এবং ভবিষ্যতে কূটনৈতিক পথে তা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালানো হবে।

সূত্র: রয়টার্স