ভারতের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কি মোদির নির্বাচনি পরিকল্পনার অংশ?

ভারতের সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে জোরেশোরে। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় রাম নবমীর মিছিলকে ব্যবহারের কথা উঠে এসেছে ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। এ ধরনের মিছিলের সংখ্যা বাড়ছে এবং বিজেপি মিছিলগুলোকে সাম্প্রদায়িক উসকানি সৃষ্টিতে ব্যবহার করছে বলে বিভিন্ন সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিহার রাজ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে এরইমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার চৌবের ছেলে অরিজিৎ শাশ্বত। ২ দিন আগেই গ্রেফতার হয়েছেন আরও দশ বিজেপি নেতা। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর বিভিন্ন বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাম্প্রদায়িক উসকানির মধ্য দিয়ে সংঘাত সৃষ্টি করে হিন্দু ভোটারদের দলে ভিড়ানোর পাঁয়তারা করছে বিজেপি। ইন্ডিয়া টুডে’র সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বিগত তিন বছরে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বৃদ্ধির আলামত মিলেছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখেই সংখ্যালঘুদের বিপরীতে হিন্দু ভোটারদের ঐক্যবদ্ধ করে নিজেদের দলে টানার এই প্রচেষ্টা নিয়েছে বিজেপি।
ইন্ডিয়া টুডের এক পরিসংখ্যানভিত্তিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে দিনকে দিন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে।

ইনফোগ্রাফিক

দ্য হিন্দু’র ৩১ মার্চের সম্পাদকীয় ভাষ্যে বলা হয়েছে,  রানিগঞ্জ-আসানসোল শিল্পাঞ্চলে এ ধরনের সংঘাত অপ্রত্যাশিত। গত তিন বছরে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিহারের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এমন সময় হলো যখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স সর্বশেষ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে। পুরো উত্তর ভারতজুড়ে প্রতিদিন সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতার সম্ভাব্যতা বাড়ছে। তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ছে এ প্রবণতা। সংঘ পরিবারে এ ঘটনায় একেবারে দায় অস্বীকার করতে পারে না। এই পরিস্থিতিতে রাম নবমী ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান নতুন কারণ হিসেবে সামনে আসছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে যখন রাজনৈতিক হাওয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠছে তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিতদের দায়িত্ব আরও বাড়ছে।

রাম নবমীর মিছিলকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করছে বিজেপি

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃত করে বিভিন্ন ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, রাম নবমী উপলক্ষে ১৭ মার্চ বিহারের ভাগলপুর শহরে একটি মিছিলের অনুমতি নেওয়া হলেও মুসলিম অধ্যুষিত স্থানগুলোতে ওই মিছিল থেকে সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়ানো হচ্ছিলো। ‘‌ভারতীয় নববর্ষ জাগরণ সমিতি'‌ নামে এক সংগঠনের ব্যানারে অনুষ্ঠিত ওই মোটরবাইক মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার চৌবের ছেলে অরিজিৎ শাশ্বত। ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিহারের এক টিভি চ্যানেলের প্রবীণ সাংবাদিক কুন্দন সিং বলেছেন, ‘‌মন্ত্রীর ছেলের উসকানিমূলক ভাষণের পর থেকেই হিংসা শুরু হয়েছিল।’

স্ক্রল.ইন’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রভাব বিস্তারে বিজেপি রাম নবমীকে ব্যবহার করছে। এতে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গজুড়ে রাম নবমীর মিছিলের সংখ্যা বেড়েছে। গত বছর রাজ্যজুড়ে ২০০টির বেশি মিছিল বের করা হয়, যাতে ‘হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ’ হওয়ার আহ্বান জানানো হয় ‘জিহাদি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে’। মিছিলগুলো ধর্মীয় হলেও বিজেপির পৃষ্ঠপোষকতাতেই এসব মিছিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে বেড়েছে অস্ত্র হাতে রাম নবমীর মিছিল

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু’র সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়েছে,  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণ জানা যাবে সরকারি তদন্তে। কিন্তু ধর্মীয় আচার কয়েকটি রাজ্যে বিভাজন সৃষ্টির কারণ হয়ে উঠেছে। রাজস্থানের যোধপুর জেলায়  রাম নবমীতে শম্ভু লালকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। যে ব্যক্তি মুসলিমবিরোধী সংঘাতে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা ও ভিডিও ধারণ করায় কারাগারে রয়েছে। মার্চেই বিহারের ভাগালপুরে সংঘ পরিবার গোষ্ঠীর আয়োজিত একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হয়। সেখানে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী চুবের ছেলে অরিজিৎ শাশ্বতের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে (১ এপ্রিল অরিজিৎ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন)। রাম নবমীর পর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে বিহারের আওরঙ্গবাদ, সামাস্তিপুর ও নাওয়াদাতে।

আউটলুক ইন্ডিয়া’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ভোটারের সংখ্যা ৩৩ শতাংশ। ফলে বিজেপি ক্ষমতায় যেতে বাধার মুখে পড়ছে। ফলে কৌশলটা হলো পুরো হিন্দু ভোটারদের দলের পতাকায় ঐক্যবদ্ধ করা।

রাম নবমীর মিছিলে অস্ত্র হাতে নামানো হয় শিশুদেরও

রাজনৈতিক বিজ্ঞানী অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর পর্যালোচনা অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ভোটাররা ঐক্যবদ্ধ নয়। কারণ, এখানকার হিন্দুরা ধর্মের ভিত্তিতে নয়, আদর্শের ভিত্তিতে ভোট দেয়। ফলে বিজেপি চেষ্টা করছে হিন্দুত্ববাদকে উসকে দিয়ে হিন্দুদের ভোট পেতে।

কট্টর হিন্দুবাদী সংগঠন মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার (এমএনএস) প্রধান রাজ থ্যাকারে গত বছর দাবি করেছিলেন, ২০১৯ সালের নির্বাচনে জিততে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির বড় ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে। আর সেই পরিকল্পনায় রয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও কারগিলের মতো যুদ্ধ।

২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরই প্রশ্ন উঠেছিল, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপির পরিকল্পনা কি বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে? ওই সময় এশিয়া টাইমস-এ ভারতীয় সাংবাদিক আদিত্য সিনহা লিখেছিলেন, বিজেপির নির্বাচন জয়ের মন্ত্র হতে যাচ্ছে– ‘গাই (গরু), গঙ্গা ও দাঙ্গা’।