কলকাতায় বিজেপি’র নেতাকর্মীরা কেন বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙলেন?

বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ  রাজা রামমোহন রায় বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরদের মূর্তি ৭০ এর দশকে নকশাল আন্দোলনের সময়ে অনেকবার ভাঙা হয়েছে। নকশাল আন্দোলনের ঘোষিত নীতিই ছিল সেটা। কিন্তু প্রায় চার দশক পরে মঙ্গলবার বিদ্যাসাগরের একটি মূর্তি ভাঙা হয়েছে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজের অভ্যন্তরে। অভিযোগ উঠছে, বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহর নেতৃত্বে একটি বিশাল মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের একাংশই ওই কলেজে ঢুকে হামলা চালায়, ভাঙচুর করে, মোটরসাইকেলে আগুন দেয় এবং পরে বিদ্যাসাগরের একটি আবক্ষ মূর্তিও ভেঙে ফেলা হয়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি’র বাংলা সংস্করণের এক প্রতিবেদনে অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে কেন নির্বাচনের চূড়ান্ত মুহূর্তে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হলো।

বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার প্রতিবাদে বিক্ষোভ

স্থানীয় ও জাতীয় টেলিভিশনের প্রচারিত ভিডিওতে দেখা গেছে, গেরুয়া পোশাক পরিহিত কিছু যুবক উন্মত্তের মতো পাথর ছুঁড়ছে, বাঁশ দিয়ে কলেজের গেটে আঘাত করছে। বিজেপি বলছে, কলেজের ভেতরে লাগানো ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ প্রকাশ্যে এলেই প্রমাণ হবে যে কারা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে। দাবি আর পাল্টা দাবি চলতে থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় অংশের মানুষ বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।

প্রবীণ সাংবাদিক শিখা মুখার্জী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বাঙালিদের মধ্যে চূড়ান্ত রাজনৈতিক বিভেদ থাকতে পারে, কিন্তু একটা জায়গা তো আমরা এক, আমাদের পরিচয় আমরা বাঙালি। আর সেই বাঙালি পরিচয়ের একটা অন্যতম দিক হলেন বিদ্যাসাগর। আমরা আজ যা, তা অনেকটাই তার অবদান, সেই বর্ণপরিচয় থেকে যার শুরু। সেই জায়গাটায় যদি কেউ হাত দেয়, তাহলে অত্যন্ত ক্ষোভ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। আর বিজেপি’র নেতারা বোঝেননি যে বিদ্যাসাগর নিয়ে আমাদের অনুভূতিটা। তাই তাদের পক্ষে ওই মূর্তি ভেঙে ফেলাটা কোনও ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়নি। কেউ বিশ্বাসই করবে না যে তৃণমূল কংগ্রেস ওটা ভেঙেছে।’

নারী আন্দোলনের কর্মী অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ বিদ্যাসাগরের ধর্মনিরপেক্ষতা আর যুক্তি নিরপেক্ষতার বড় সমর্থক। তিনি বলেন, ‘এর আগে সত্তরের দশকেও তো বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতিতে এটা কোনও নতুন ব্যাপার না। বিদ্যাসাগরকে কি বাঙালি কোনওদিনই তার প্রাপ্য সম্মান দিয়েছে? তার জীবৎকালেও তো বিদ্যাসাগরের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে, নানাভাবে অপমান করা হয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে বলুন, ব্যবসার ক্ষেত্রে বলুন, সতীদাহের প্রশ্নে হোক, বিধবা বিবাহের প্রসঙ্গে হোক বা তার সঙ্গে বাঙালি সমাজ অসদাচরণ করেই এসেছে। তার ব্যক্তিত্বকে বাঙালি সমাজ মেনে নিতে পারেনি কখনোই।’

বাঙালি সমাজ কতটা বিদ্যাসাগরকে মেনে নিয়েছে বা সনাতন হিন্দু ধর্ম তার জীবৎকালেও কতো দুর্ব্যবহার করেছে, তা গবেষণার বিষয়, কিন্তু ভোট প্রচারের একেবারে শেষ বেলায় কেন বিদ্যাসাগরকে নিয়ে এতো সমালোচনার সৃষ্টি হলো? এই বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিত ভট্টাচার্য বলেন, ‘উত্তর ভারতের নানা রাজ্যে বিজেপি’র যে আগ্রাসী মনোভাব আমরা দেখি, এখন পশ্চিমবঙ্গেও তাদের সেই মনোভাব লক্ষ্য করছি। এর একটা মূল কারণ হলো, এ রাজ্যে বিজেপির যে নতুন ভোটব্যাঙ্ক, তার একটা বড় অংশ সাবেক বামপন্থী কর্মী-সমর্থক। এই অংশটা মনে করছে বিজেপির সঙ্গে থাকলেই তৃণমূল কংগ্রেসকে উচিত শিক্ষা দেওয়া যাবে।’

বিশ্বজিত আরও বলেন, ‘তাই তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে যে একটা আগ্রাসী অবস্থান নিয়েছিল বামপন্থীদের ব্যাপারে, তারই এখন প্রত্যুত্তর দিচ্ছে পুরণো বামপন্থী ভোটব্যাঙ্ক। দুই তরফেই এই একই স্ট্র্যাটেজি নেওয়া হয়েছে।’

বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেস- দুই তরফেই দাবি পাল্টা দাবির মধ্যে সামাজিক মাধ্যমেও মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই ব্যাপক চর্চা চলছে এই ঘটনার। একদিকে যেমন বাংলার বাইরের অনেক মানুষ ফেসবুক-টুইটারে প্রশ্ন তুলছেন কে এই বিদ্যাসাগর, অনেকে গুগল সার্চ করছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম।

বেশ কিছু তথাকথিত হিন্দুত্ববাদী সামাজিক মাধ্যম প্রোফাইল থেকে আবার রূঢ় ভাষা ব্যবহার করে মন্তব্য করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিদ্যাসাগর সনাতন হিন্দুধর্ম বিরোধী ছিলেন। কারণ তিনি সতীদাহ প্রথা রদ করা বা বিধবা বিবাহ প্রচলনের মতো কর্মকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিলেন। যদিও ওই প্রোফাইলগুলোর মালিকরা সত্যিই হিন্দুত্ববাদী কী না, তা যাচাই করতে পারেনি বিবিসি বাংলা।

এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক শিখা মুখার্জী বলেন, ‘যারা হিন্দুত্ব নিয়ে রাজনীতি করে, তাদের তো সনাতন হিন্দু ধর্মের ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের মতো পন্ডিতদের তো সহ্য না করতে পারাটাই স্বাভাবিক। সনাতন হিন্দু ধর্মে অগাধ পাণ্ডিত্য থাকা স্বত্ত্বেও তিনি একের পর এক সমাজ সংস্কারের কাজ করেছেন, নবজাগরণ ঘটিয়েছেন। এজন্য সেই সময়ের তথাকথিত হিন্দু সমাজ বিদ্যাসাগরকে কম অপমান তো করেনি!’