ইউরোপীয় এমপিদের সফরের মধ্যেই কাশ্মিরে ৬ জনকে গুলি করে হত্যা

ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন ও বিশেষ অধিকার বাতিলের পর প্রথম কোনও বিদেশি প্রতিনিধি দলের সফরের মধ্যেই সেখানে ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মঙ্গলবার কাশ্মির পুলিশ জানায়, দক্ষিণ কাশ্মিরের কুলগাম জেলায় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ছয় শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করেছে জঙ্গিরা। এই ছয় শ্রমিক পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। ধারণা করা হচ্ছে, গত কয়েকদিন ধরে সেখানে বেসামরিক লোকদের টার্গেট করে হত্যার ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবারের হত্যাকাণ্ড ঘটানো হতে পারে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস ও ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে। 

1

গত ৫ আগস্ট ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয় এবং জম্মু ও কাশ্মিরকে বিভক্ত করে ফেলা হয়। ওই দিন সকাল থেকে কার্যত অচলাবস্থার মধ্যে নিমজ্জিত হয় দুনিয়ার ভূস্বর্গ খ্যাত কাশ্মির উপত্যকা। এ পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে কাশ্মিরজুড়ে মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক অতিরিক্ত সেনা। গ্রেফতার করা হয় সেখানকার বিপুলসংখ্যক স্বাধীনতাপন্থী ও ভারতপন্থী রাজনৈতিক নেতাকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্র গত দুই মাস ধরে ভারত সরকারের কাশ্মির নীতির তীব্র সমালোচনা করে আসছে। বিদেশি সাংবাদিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা কাশ্মিরে যাওয়ার অনুমতি চেয়েও পাননি। ২৮ অক্টোবর ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলকে সফরের অনুমতি দিলে মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) তারা সেখানে প্রথম দিন কাটান।

গত কয়েক মাসের মধ্যে এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। দুই পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিহতদের ছয়জনই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা এবং নির্মাণ শ্রমিক। তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অপর এক শ্রমিক আহত হয়েছে।

টুইটারে কাশ্মির পুলিশ পাঁচ বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছে। পরে স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা আরও একজনের নিহতের কথা নিশ্চিত করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, শ্রমিকদের বাসস্থান থেকে গুলিবিদ্ধ পাঁচটি দেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

প্রায় তিন দশক ধরে ভারতবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম চলছে কাশ্মিরে। পুলিশ দাবি করছে, এসব গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে অ-কাশ্মিরিদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে। কাশ্মিরে কাজ করা বা বাণিজ্য করার কারণে আগস্টের পর থেকে এমন প্রবণতা দেখা দিয়েছে।

ভারতের পক্ষ থেকে কাশ্মিরে জঙ্গিদের সমর্থন ও সহযোগিতা দেওয়ার জন্য পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করে আসছে। তবে ইসলামাবাদ এমন অভিযোগ অস্বীকার করে। উভয় দেশই পুরো কাশ্মিরকে নিজেদের বলে দাবি করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণে একাংশ রয়েছে।

2

মঙ্গলবারের হত্যাকাণ্ড এমন সময় ঘটলো যখন কাশ্মিরে ২৩ জন ইউরোপীয় এমপি সফরে রয়েছেন। এদিন বিভিন্ন স্থানে পাথর নিক্ষেপ করে বিক্ষোভ হয়। ইউরোপীয় এমপিদের সফর ঘিরে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের দাবি, সরকার বিদেশি প্রতিনিধিদের দেখাতে চাইছে, সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। যদিও এখনও বেশিরভাগ মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং নিরাপত্তাবাহিনীর উপস্থিতিতে দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তা ও এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, শ্রীনগরের অন্তত ৪০টি স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে। ইইউ প্রতিনিধি দলের আগমনের পূর্বে এসব বিক্ষোভ শুরু হয় এবং দিনব্যাপী চলে। নিরাপত্তাবাহিনী টিয়ার গ্যাস ছুড়ে বলে রয়টার্সকে বলেছেন পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা।

পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, অন্তত আটজন বিক্ষোভকারীকে শ্রীনগরের প্রধান হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বিক্ষোভকারী নিরাপত্তাবাহিনীকে লক্ষ্য করে আরও অন্তত ছয়টি শহরে বিক্ষোভ করেছে।

ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, কাশ্মিরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে এবং ইইউ প্রতিনিধি দলের সফরের ফলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সমালোচনা বন্ধ হবে।

সোমবার (২৮ অক্টোবর) প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘ইউরোপের প্রতিনিধিরা কাশ্মিরের পরিস্থিতি দেখার আগ্রহ প্রকাশ করায় আমরা খুশি। আশা করি নিজের চোখে দেখে তারা বুঝতে পারবেন সীমান্ত পেরিয়ে আসা জঙ্গিরা কাশ্মিরের জনজীবনের কত ক্ষতি করছে ও আমরা কীভাবে জঙ্গি হামলার মোকাবিলা করছি। জম্মু ও কাশ্মিরের সঙ্গে লাদাখের বাসিন্দাদের জীবন ও সংস্কৃতির পার্থক্য কতটা, তাও তারা বুঝবেন।’

ইইউ প্রতিনিধি দলের সফরকে ঘিরে ইতোমধ্যেই দেখা দিয়েছে প্রবল বিতর্ক। কংগ্রেস, সিপিএম, সিপিআইসহ ভারতের বিভিন্ন দলের নেতাদেরই যখন শ্রীনগর বিমানবন্দর থেকে ফিরে আসতে হচ্ছে, তখন কীভাবে এই বিদেশি এমপিরা কাশ্মিরে যেতে পারলেন সেই প্রশ্নও তুলছেন ভারতের বিরোধী রাজনীতিবিদরা। কংগ্রেসের আনন্দ শর্মা, সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরিরা এই ইস্যুতেই সরকারের কৈফিয়ত দাবি করছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী টুইটারে লিখেছেন, এই সফরে কোনও বড় ভুল আছে।