টিকার তাগাদা এড়াতেই লন্ডনে গা-ঢাকা দিয়েছেন সেরামের সিইও?

ভারতের নাগরিকদের বঞ্চিত করে সেরাম ইনস্টিটিউট মুনাফার লোভে বিদেশে টিকা রফতানি করেছে, দেশের ভেতর এই অব্যাহত সমালোচনার মুখে এবার প্রকাশ্যে মুখ খুললেন সংস্থার সিইও আদর পুনাওয়ালা।

লন্ডনে নিজের ডেরা থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে তিনি আজ (মঙ্গলবার) জানিয়ে দিয়েছেন, ভারতীয়দের বঞ্চিত করে সেরাম কখনও বিদেশে টিকা পাঠায়নি, পাঠাবেও না।

তার বক্তব্যে এটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এখন থেকে দু’তিন মাস পরও বাংলাদেশসহ বাইরের দেশগুলোকে কোভিশিল্ড পাঠানোর কোনও সম্ভাবনাই নেই। অর্থাৎ কোভিশিল্ডের জন্য বাংলাদেশের অপেক্ষা আরও দীর্ঘায়িত হবে।

বিবৃতিতে তিনি পরিষ্কার বলেছেন, ১৪০ কোটির দেশ ভারতে যে বিপুল জনসংখ্যা, তাতে দু-তিন মাসে কখনও এখানে টিকাদান অভিযান সম্পূর্ণ হতে পারে না। এর জন্য অনেক বেশি সময় লাগবে। যেহেতু ভারতীয়রাই কোভিশিল্ডে অগ্রাধিকার পাবেন, তাই বিদেশে রফতানি এই মুহূর্তে সম্ভব হবে না। এটাও তার বক্তব্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে।

সাইরাস পুনাওয়ালা, নিজের ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতিদের সঙ্গে আদর পুনাওয়ালা

পুনাওয়ালা লন্ডনে কেন?

কিন্তু ভারতে টিকা উৎপাদনে যখন বিপুল সংকট চলছে, চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে, তখন সেরামের কর্ণধার কেন সুদূর লন্ডনে গিয়ে বসে আছেন?

মাসখানেক আগে লন্ডনে পরিবারের সঙ্গে যোগ দিয়ে আদর পুনাওয়ালা নিজেই দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা মন্ত্রীরা তাকে যেভাবে টেলিফোনে টিকা দেওয়ার জন্য জোরাজুরি শুরু করেছিলেন, সেটা প্রায় হুমকির পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল।

তার কথায় পরিষ্কার ইঙ্গিত ছিল, এই হুমকি-ধমকি থেকে বাঁচতেই তিনি লন্ডনে পাড়ি দিয়েছেন। স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে এসে বিলেতে যোগ দিয়েছেন। দিল্লির পাশাপাশি বিভিন্ন রাজ্য সরকারও যে তাকে নানাভাবে চাপে রেখেছিল, কার্যত সে কথাও কবুল করেছিলেন তিনি।

লন্ডনের অভিজাত মেফেয়ারে পোলিশ এক ধনকুবেরের কাছ থেকে পুনাওয়ালা পরিবার যে সপ্তাহে ৫০ হাজার পাউন্ডের (৭০ হাজার ডলার) রেকর্ড ভাড়া দিয়ে একটি বিলাসবহুল ম্যানসন ভাড়া করেছে, সে খবরও ফাঁস হয়েছিল বিলেতের ট্যাবলয়েডে। 

এখন ভারতে সেরামের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিচ্ছেন, তাদের প্রতিষ্ঠান যেসব দেশের সঙ্গে টিকা পাঠানোর চুক্তি রক্ষা করতে পারেনি তারা আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে পারে এমন একটা আশঙ্কা আছেই। আগেভাগে সেই সম্ভাব্য আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেওয়াটাও আদর পুনাওয়ালার বিলেতে যাওয়ার একটা প্রধান কারণ।

তবে অন্য কোনও দেশ যদি আইনি পদক্ষেপ নেয়ও, বাংলাদেশ সে রাস্তায় হাঁটবে না বলেই বিশ্বাস দিল্লিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিশেষজ্ঞ ও জেএনইউ-এর অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ধরের।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সময়ে টিকা না পেলেও বাংলাদেশ মামলার পথে যাবে না বলেই আমার ধারণা। কারণ, সেটা অনেক জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। দু’চার মাস বাদে যদি টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকেও, মামলা হলে সেটা আরও পিছিয়ে যাবে।’ 

‘তাছাড়া কোভিশিল্ড পাঠানোর চুক্তিটা সেরাম ও বেক্সিমকো ফার্মার মধ্যে হলেও দুদেশের সরকারও কিন্তু সেটাকে ‘ব্যাক’ করেছে, কাজেই ঢাকা ও দিল্লির পারস্পরিক সম্পর্কও এখানে একটা ফ্যাক্টরের কাজ করবে।’

তবে সার্বিকভাবে ভারতের ভেতর থেকে ও সেই সঙ্গে বাইরে থেকেও তাগাদা, হুমকি এবং মামলার ভয়–এই পটভূমিতেই যে আদর পুনাওয়ালা সপরিবারে এই মহামারিতেও লন্ডনে গেছেন তা বোঝাই যাচ্ছে।

মাস কয়েক আগেও যিনি ভারতীয় মিডিয়ার কাছে ছিলেন একরকম ‘ডার্লিং’, তাকেই এখন একরকম খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। প্রথম আড়াই মাসে বিদেশে টিকা পাঠানোর জন্য আম আদমি পার্টির মতো নানা রাজনৈতিক দল সরকারের পাশাপাশি আদর পুনাওয়ালাকেও কাঠগড়ায় তুলছে। 

আদরের বাবা ও সেরাম ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান সাইরাস পুনাওয়ালাও ক’দিন হলো লন্ডনে ছেলে ও ছেলের পরিবারের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।

তিনি অবশ্য এর গুরুত্ব খাটো করে দেখিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে বলেছেন, ‘আমরা তো প্রতিবছরই মে-জুন মাসে গরমের ছুটি কাটাতে লন্ডনে আসি, এবারেও এসেছি। আদরের শিশুরাও এখানকার স্কুলে পড়ে, আর আমিও জুনের গোড়ায় বিলেতের ডার্বিটা মিস করতে পারি না। তো এরমধ্যে অন্য উদ্দেশ্য কেন খোঁজা হচ্ছে জানি না!’

কিন্তু প্রতিবছর মহামারি থাকে না, থাকে না বাড়তি টিকার জন্য জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে তাগাদাও।

পুনাওয়ালা ফ্যামিলি সেই তাগাদা থেকে নিজেদের কিছুটা আড়াল করতেই মেফেয়ারের বিলাসবহুল প্রাসাদে একরকম গাঢাকা দিয়েছেন, এমন ধারণা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।