ভবানীপুর দেখালো মোদি বিরোধী প্রধান মুখ মমতা

ভবানীপুরে বিশাল জয় পেলেন মমতা। অন্যদিকে জামানত বাতিল থেকে কোনও রকমে রক্ষা পেলো বিজেপি। ব্যাপক হাঁকডাক করেও শেষ পর্যন্ত বিজেপির পরাজয়ে, নন্দীগ্রামের প্রতিশোধ নিলো তৃণমূল। অপরদিকে, এই চব্বিশের লোকসভা ভোটের আগে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মোদি বিরোধী প্রধান মুখ হিসেবে উঠে আসলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনটাই মত রাজনৈতিক মহলের।

একুশের বিধানসভা ভোটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় পাওয়ার পরও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নন্দীগ্রামে হেরে যাওয়াটা গলায় কাঁটার মতো বিঁধছিল তৃণমূলের। ভোটের পর থেকে দলের সুপ্রিমোর এই হার নিয়ে বিরোধী শিবিরের কটাক্ষ নীরবেই হজম করতে হচ্ছিল তাদের। সেই আক্রমণের বন্যা আরও বাড়ছিল সর্বভারতীয় স্তরে তৃণমূলকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়াকে কেন্দ্র করে। একাধিক অপ্রিয় প্রশ্নবান উড়ে আসছিল বঙ্গ বিজেপির কাছ থেকে। সেই সব প্রশ্নে উত্তর দেওয়ার অপেক্ষায় ছিল তৃণমূল। যেভাবে একুশে বিজেপির ক্ষমতা দখলের স্বপ্নকে উড়িয়ে দিয়েছিল, ঠিক একই কায়দায় তারা ভবানীপুওে উপনির্বাচনের প্রেস্টিজ ফাইটে গেরুয়া শিবিরকে রেকর্ড মার্জিনে হারিয়ে দুরমুশ করে দিলো।

এই জয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারলো তৃণমূল। এক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার অবস্থানকে ফের দৃঢ় করলেন। দুই, মমতার নেতৃত্বে তৃণমূলই পারে বিজেপির বিজয়রথকে থামিয়ে দিতে। একুশের ভোটের পর আবারও তা প্রমাণ হলো। এর ফলে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মোদি বিরোধী লড়াইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার নেতৃত্বকেও প্রতিষ্ঠিত করলেন। শুধু তাই নয়, এই বিজয় সর্বভারতীয় স্তরে তৃণমূলকে আঞ্চলিক স্তর থেকে জাতীয় দল হিসেবেও সামনের সারিতে এনে দিয়েছে। এমনটাই মত রাজনৈতিক মহলের।

এ ধরনের একটা অবস্থানে তৃণমূল পৌঁছতে পারে সেটা আঁচ করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বভারতীয় স্তরে দলকে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছিলেন একুশের ভোটের পরে। গোটা দেশজুড়ে মোদি-শাহের রমরমা চলছে, সেখানে বাংলার মমতার বিজেপিকে রুখে দেওয়া জাতীয় রাজনীতিতে ইতোমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। সর্বভারতীয় দল হয়েও কংগ্রেসের অবনমন আর আঞ্চলিক দলগুলো যেখানে বিজেপির আগ্রাসনে ভীত, সেখানে তৃণমূলের এই ভূমিকা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

ভবানীপুরে জয়ের পরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব। তিনি বলেছেন, ‘মমতাদির জয়ই সত্যের জয়।’ শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী তথা ডিএমকে প্রধান স্ট্যালিন। তিনি বলেছেন, ‘ভবানীপুর উপ-নির্বাচনে মমতার জয়ের জন্য শুভেচ্ছা। বিরাট ভোটের প্রাপ্য জানান দিচ্ছে আপনার দিকেই মানুষের মতামত রয়েছে।’

শুভেচ্ছা জানিয়েছেন কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন এমপি কীর্তি আজাদ। তিনি জানিয়েছেন, ‘মমতা দিদি একজন বিচক্ষণ নেত্রী। সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করেন তিনি। ভবানীপুর উপনির্বাচনের জয়ের জন্য শুভেচ্ছা জানাই।’ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজুনহি ফালেরিও। বলেছেন, বিজেপির বিরুদ্ধে আগামী দিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেত্রী চান তিনি।

একুশের জয়ের পরেও অখিলেশ যাদব বলেছিলেন, একজন নারীকে বিজেপি যেভাবে ‘দিদি ও দিদি' বলে কটাক্ষ করেছিল, তার যোগ্য জবাব দিয়েছে বাংলার জনগণ। বাংলার সচেতন নাগরিকরা বিজেপি-র ঘৃণার রাজনীতিকে পরাজিত করেছে।’

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছিলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই জয়ের জন্য অভিনন্দন। কী অসাধারণ লড়াই!’ রাষ্ট্রীয় জনতা দলের লালু প্রসাদ যাদব বলেছিলেন, ‘মমতাজীকে এই ঐতিহাসিক জয়ের জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা। সব রকম প্রতিবন্ধকতাকে পার করে এই জয়। আমি পশ্চিমবঙ্গের জনগণকেও অভিনন্দন জানাতে চাই। যারা বিজেপির অপপ্রচারের ফাঁদে না পড়ে দিদির উপর আস্থা রেখেছেন।’

জম্মু-কাশ্মিরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহও শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন মমতাকে। তিনি বলেছিলেন, ‘মমতা দিদিকে আন্তরিক অভিনন্দন। পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশন এবং বিজেপি আপনাদের জন্য সব রকম প্রতিকূলতা তৈরি করেছিল। আপনারা যে সেই সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে বিজয়ী হয়েছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’

গত এপ্রিল মাসেই বিজেপি বিরোধী জোট গড়তে কংগ্রেস-সহ যে ১৫টি দলকে মমতা চিঠি লিখেছিলেন, তাদের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিল কাশ্মিরের পিডিপি নেতৃত্ব। শিবসেনার তরফ থেকে বলা হয়েছিল, তারা ভাবনা-চিন্তা করবে। পিডিপি সভাপতি মেহবুবা মুফতি বলেছিলেন, ‘আমি উনার সঙ্গে একমত। দেশের গণতন্ত্র সুরক্ষিত রাখতে এবং মূল্যবোধ অটুট রাখতে বিরোধীদের একজোট হওয়া জরুরি। শিবসেনা সাংসদ সঞ্জয় রাউত বলেছিলেন, ‘আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের ফল অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতির দিক নির্ধারণ করবে।’

বিজেডি এবং ওয়াইএসআর কংগ্রেসের মতো বিজেপির প্রতি ‘নরমপন্থী’ দলকেও বিজেপি-বিরোধী জোটে শামিল করার জন্য দরজা খুলে রেখেছেন মমতা। তিনি সাফ বলেছেন, ‘আমার সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জগন রেড্ডি, উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে। যদি কোনও রাজনৈতিক ঝড় ওঠে, কেউ থামাতে পারবেন না।’

এদিকে তৃণমূল নেতা তথা মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ভবানীপুরের জয়ের পর পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, দেশজুড়ে বিজেপি বিরোধী জোটের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, ‘বিজেপি বিরোধী মুখ হিসেবে মমতাকেই চান ভারতের মানুষ। কংগ্রেস সেটা বোঝার চেষ্টা করছে না। কংগ্রেস তার শক্তি হারিয়েছে। সিপিএমের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। সংগঠন ধরে রাখতে পারেনি। পাঞ্জাবেও কাউকে সরিয়ে দিচ্ছে, কাউকে আনছে। সিপিএমের মতো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। সেটা আমরাও চাই না। আমরা চাই বিজেপির বিরুদ্ধে সব শক্তি একসঙ্গে থাকুক।’

কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী; আজ সারা দেশে মোদি বিরোধী হিসেবে মমতার নাম ছড়িয়ে পড়েছে। তৃণমূল সেই আবহাওয়ার ফায়দা নিতে চায়। তাই কংগ্রেসের দাদাগিরি না মেনে বিজেপি বিরোধী দলগুলোর মঞ্চ তৈরির প্রস্তুতি শুরু করেছে তারা। এই মঞ্চই চব্বিশের লোকসভা ভোটে মোদি-শাহকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ঘুঁটি সাজাচ্ছে। আর এই মঞ্চ যদি শেষ পর্যন্ত একত্রে লড়াই করতে পারে তাহলে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মমতাই হয়ে উঠবেন অবিসংবাদিত নেত্রী। আর অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার!