আবেগে উৎসাহে ভাঙলো পুলিশ বেষ্টনী

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র উৎসব ঘিরে উপচে পড়া ভিড় নন্দনে

শেষ কবে বাংলাদেশি সিনেমা দেখতে এমন ভিড় হয়েছিল তা মনে করতে পারছিলেন না কেউই! শনিবার কলকাতার নন্দনে বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং কলকাতায় বাংলাদেশ উপ হাইকমিশন-এর তত্ত্বাবধানে শুরু হওয়া পাঁচদিনের চলচ্চিত্র উৎসবে আবেগের বাঁধ ভাঙলো কলকাতাবাসী। উদ্বোধনী চলচ্চিত্র ‘হাওয়া’ দেখতে দীর্ঘ লাইন চলে গেলো নন্দন চত্বরের বাইরে। আবেগে উৎসাহে ভাঙলো কলকাতা পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী।

কলকাতার নন্দন চত্বর, হেমন্তের বিকেলে প্রেক্ষাগৃহের ভেতরে চাঁদের হাট। শনিবার শুরু হল পাঁচদিনের চলচ্চিত্র উৎসব। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী গায়ক বাবুল সুপ্রিয়, সাইমুম সারোয়ার, চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান, গৌতম ঘোষ, উপ-রাষ্ট্রদূত আন্দালিব ইলিয়াসসহ বিশিষ্ট জনেরা।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড.হাছান মাহমুদ, এমপি

অতিথিদের যে উত্তরীয় দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে, তাতে আগামী কয়েকদিনে এই চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের যে কয়েকটি সিনেমা দেখানো হবে, সেগুলোর নামোল্লেখ রয়েছে। নন্দনজুড়ে আজ জনজোয়ার। ‘হাওয়া’ সহ একগুচ্ছ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দেখতে নন্দন চত্বরে যে ভিড় হয়েছে, তা দেখে অবাক বিশিষ্টজনেরা।

উদ্বোধনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘সবকিছুর উপরে সত্য, আমরা বাঙালি। দুপারের বাঙালির কলকাতার ওপর আবেগ রয়েছে। রবি ঠাকুরের শহর, সত্যজিতের শহর। ভৌগলিক দূরত্ব থাকলেও মনের দিকে দূরত্ব নেই আমাদের। বাংলাদেশ ও এপার বাংলা যদি যৌথভাবে কাজ করতে পারি, তাহলে অনেক কিছু ছাড়িয়ে যাবে সেই ছবি। সেজন্য দুই বাংলাকে উদ্যোগী হতে হবে।’

উপস্থিত ছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় বাংলাদেশি অভিনেত্রী জয়া আহসান

বিশিষ্ট পরিচালক গৌতম ঘোষ বলেন, ‘এপার আর ওপার বাংলার মানুষেরা চাইলেও, ছবি সেভাবে পৌঁছে যাচ্ছে না। তার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে চলচ্চিত্র উৎসবের’। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গৌতম ঘোষ যে তথ্যচিত্র বানাচ্ছেন, তা খুব শিগগিরই শেষ হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। 

শনিবারের অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাবুল সুপ্রিয়। বক্তব্য রাখতে উঠেই তিনি বলেছেন, আজ তিনি যেটুকু বলছেন, বলবেন সবটুকু শিল্পী বাবুলের কথা। তিনি জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে এপারের টান বহুদিনের, এবং তাতে ভাটা পড়েনি। শিল্প এই দু’দেশের বন্ধনকে আরও অটুট করেছে। দুই বাংলা এবং সিনেমা নিয়ে আক্ষেপ ঝরে পড়ে তার গলাতেও। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্যোগ নিয়ে তিনি আশাবাদী, আগামী দিনে আরও অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে পড়শি দেশের ছবি। এই অনুষ্ঠানের খবর আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ুক, এই শিল্প, ছবি, গান মানুষের মনের দেওয়াল ভাঙতে পারে বলেই মনে করছেন শিল্পী বাবুল।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘বাংলার গান’ গেয়ে শুনিয়েছেন বাবুল। অনুষ্ঠান মঞ্চে দাঁড়িয়েই হাছান মাহমুদ বাবুল সুপ্রিয়র হাতে পাঞ্জাবি তুলে দেন, বাবুল সুপ্রিয়র স্ত্রীর জন্য দিয়েছেন জামদানি। তুলে দেওয়া হয় নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রতীক নৌকো। গৌতম ঘোষের হাতে তুলে দেওয়া হয় কিছু বই। জয়া আহসান, এই মুহূর্তে তিনি দুই বাংলায় জনপ্রিয় অভিনেত্রী। জয়া বলেন, ‘শিল্পের, সিনেমার দেশ হয় না। খুব ভাল লাগছে। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।’

পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে উপহার তুলে দেন প্রধান অতিথি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ডা. হাছান মাহমুদ, এমপি

কলকাতায় নিযুক্ত বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রদূত আন্দালিব ইলিয়াস বলেন, ‘এপার বাংলায় ওপার বাংলার ছবির চাহিদা অনেক। সেই কারণেই এবার চতুর্থ চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। এপার বাংলায় ওই বাংলার ছবির এত চাহিদার কারণ, ভাষা একই। মানুষ একাত্মবোধ করতে পারেন। দুই বাংলার সম্পর্ক শুধু ধরে রাখা নয়, আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই এই উৎসব।’

উপ-দূতাবাসের কাউন্সেলর রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘দুই বাংলায় যে সিনেমাগুলো হচ্ছে, আমি এপার বাংলার অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি এখানের মানুষজন ওপারের কাজ খুব পছন্দ করছে। দুই বাংলার সিনেমা কালচার একই রকম। একসঙ্গে কাজ হলে, অনেক বেশি এগিয়ে যেত পারব আমরা।’ 

এদিকে উৎসবের প্রথমদিনে প্রদর্শিত হয়েছে— ‘হাসিনা এ ডটার’স টেল, ‘হাওয়া’, ‘পরান’ এবং ‘চিরঞ্জীব মুজিব’। তবে কলকাতাবাসী এখন ‘হাওয়া’য় ভাসছে। চাহিদা থাকার জন্য এ দিন দুবার দেখানো হয় চলচ্চিত্রটি। স্থানীয় সময় বেলা ১২টায় প্রথম প্রদর্শনীতে দর্শক আসন ভরে যাওয়ায় মেঝেতে বসে ‘হাওয়া’ সিনেমা দেখেন অনেকেই।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী

এ বছর ৩৭টি বাংলাদেশি চলচ্চিত্র নিয়ে চতুর্থ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব সাজানো হয়েছে। এসব চলচ্চিত্র দেখানো হচ্ছে কলকাতার নন্দনের ১, ২ ও ৩ নম্বর প্রক্ষাগৃহে। উৎসব শেষ হবে আগামী ২ নভেম্বর। প্রতিদিন স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে প্রেক্ষাগৃহগুলো। 

এবার উৎসবের পাঁচদিনে (২৯ অক্টোবর-২ নভম্বর) যে ৩৭টি বাংলাদেশি চলচ্চিত্র দেখানো হবে সেগুলো হলো—‘গুণিন’, ‘হৃদিতা’, ‘বিউটি সার্কাস’, ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’, ‘পায়ের তলায় মাটি নাই’, ‘পাপ পুণ্য’, ‘কালবেলা’, ‘চন্দ্রাবতী কথা’, ‘চিরঞ্জীব মুজিব’, ‘রেহানা মরিয়ম নূর’, ‘নোনা জলের কাব্য’, ‘রাত জাগা ফুল’, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’, ‘গোর’, ‘গলুই’, ‘গণ্ডি’, ‘বিশ্ব সুন্দরী’, ‘রুপসা নদীর বাঁকে’, ‘শাটল ট্রেন’, ‘মনের মত মানুষ পাইলাম না’, ‘ন-ডরাই’, ‘কমলা রকেট’, ‘গহীন বালুচর’ এবং ‘৪৯ বাতাস’। 

প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে থাকছে—‘হাসিনা এ ডটার’স টেল’, ‘বদ্ধভূমিতে একদিন’, ‘একটি দেশের জন্য গান’ এবং ‘মধুমতি পারের মানুষটি: শেখ মুজিবুর রহমান’। 

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে থাকছে আটটি। সেগুলো হলো—‘ধড়’, ‘ময়না’, ‘ট্রানজিট’, ‘কোথায় পাব তারে’, ‘ফেরা’, ‘নারী জীবন’, ‘কাগজ খেলা’ এবং ‘আড়ং’।