২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিবঙ্গের মুসলিম ভোটব্যাংক পুরোটাই চলে গিয়েছিল শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে। যার প্রভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চা। সামনেই পঞ্চায়েত আর তারপরেই চব্বিশের লোকসভা ভোট। তাই ফের গেরুয়া নজর রাজ্যের মুসলিম ভোটে। এবার তৃণমূলের এই মুসলিম ভোটব্যাংকে ফাটল ধরাতে সক্রিয় হচ্ছে বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চা। চলতি মাসের ১৮ তারিখ থেকে মুসলিম অধ্যুষিত জেলা মুর্শিদাবাদে তিনদিনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে সেই রোডম্যাপই প্রস্তুত করা হবে বলেই সূত্রের খবর।
পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪ টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ১০০ থেকে ১২৫ টি আসনে মুসলিম ভোটাররা নির্ণায়ক শক্তিতে রয়েছেন। এসব আসনে ২০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত মুসলিম ভোটার রয়েছেন। জেলাভিত্তিক হিসাবে মুর্শিদাবাদ, মালদা এবং উত্তর দিনাজপুরে ৪৩ টি আসনে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী উত্তর দিনাজপুরে মুসলিম জনসংখ্যার হার ৫০.৯২ শতাংশ। মুর্শিদাবাদে ৭০.২ শতাংশ এবং মালদহে ৫১. ২৭ শতাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের বসবাস। এছাড়া নদিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান এবং বীরভূম জেলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় মুসলিম ভোটার রয়েছেন। এসবের মধ্যে কোনও কোনও স্থানে ৩০ শতাংশের বেশি মুসলিম ভোটার। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গে ২ কোটি ৪৬ লাখ মুসলমান রয়েছেন। তিনটি জেলা–মুর্শিদাবাদ, মালদা ও উত্তর দিনাজপুরে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হলো মুসলিম। এই তিনটি জেলা বাংলাদেশের সীমান্তে অবস্থিত। মুসলিমরা নির্ণায়ক শক্তি থাকা ১০০ থেকে ১২৫ আসনের মধ্যে ৪৩টি অবস্থিত ওই তিনটি জেলায়।
বিগত ২০২১- এর বিধানসভা ভোটে বিজেপি সাকুল্যে ৩৮ শতাংশের কিছু বেশি ভোট আর ৭৭ টি আসন পেলেও, সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটের ঝুলি কার্যত শূন্যই রয়ে গেছে। একুশের বিধানসভা ভোটে এই সবকটি আসনই চলে গেছে তৃণমূলের দখলে। মুসলিম অধ্যুষিত মূর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, বীরভূম, নদিয়া, হাওড়া ও দক্ষ্মিণ ২৪ পরগণার মতো সাতটি জেলায় দলের বুথ সংগঠন খুবই দুর্বল। বহু এলাকায় নেই বললেই চলে।
পঞ্চায়েত ভোটকে সামনে রেখে চব্বিশের লোকসভার জন্য বুথ সংগঠনকে গুছিয়ে নিতে চাইছে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি। আর তাই সবচেয়ে দুর্বল বলে মুসলিম প্রধান এলাকাগুলোতে সংগঠন গড়ে না তুলতে পারলে সেক্ষেত্রে তৃণমূলবিরোধী ভোট বামেদের দখলে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটের আগেই সিএএ নিয়ে সরগরম রাজ্য রাজনীতি। সিএএ লাগু হলে নাগরিকত্ব হারানো আশঙ্কা তৈরি হবে বলে বিজেপি বিরোধীদের লাগাতার প্রচার চলছে মুসলিমদের মধ্যে। এই আবহে সিএএ নিয়ে দেশীয় মুসলিমদের আশঙ্কা দূর করার পাশাপাশি তাদের উন্নয়নে বিজেপি কতটা আন্তরিক তা তুলে ধরার লক্ষ্যেই বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার তিন দিনের প্রশিক্ষণ শিবির। এই শিবির হবে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। শিবিরের উদ্বোধন করতে রাজ্যে আসছেন সংখ্যালঘু মোর্চার সর্বভারতীয় সভাপতি জামাল সিদ্দিকি। থাকবেন বঙ্গ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও।
পঞ্চায়েত ভোটের আগে রাজ্যে সংখ্যালঘু মোর্চার শিবির ও তার স্থান নির্বাচন নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। জানা গেছে, এই প্রশিক্ষণ শিবিরে রাজ্যের প্রতিটি জেলা থেকে আসা রাজ্য বিজেপির সংখ্যালঘু নেতা-কর্মীদের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ ও সংখ্যালঘু উন্নয়নের পাঠ পড়াতে উপস্থিত থাকবেন বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ, বিজেপি নেতা সজল ঘোষ, পদ্মশ্রী মাসুম আখতার ও সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়রা।
বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার রাজ্য সভাপতি চার্লস নন্দীর দাবি, এই কঠিন সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা আমাদের সঙ্গে আসছেন। বহরুমপুরের শিবিরে ২০০ সংখ্যালঘু আমাদের দলে যোগ দেবেন। জেলায় জেলায় ঘুরে বুঝেছি, রাজ্যের মুসলিমরা ভালো নেই। তারা মনে করছেন, তৃণমূল তাদের চিরকাল ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করছে। বাবা কৃষক থাকলেও মুসলিম পরিবারের তরুণরা চাইছেন চাকরি। তারা বুঝতে পারছেন এখানে চাকরি নেই। তিন তালাক ওঠে যাওয়ায় মুসলিম নারীরাও খুশি। তারা আমাদের সঙ্গে আসতে চাইছেন। সিএএ নিয়ে তাদের ভুল বোঝানো হয়েছে। সিএএ হলে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে না। এটা তারা বলছেন।”
সম্প্রতি আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতকে কখনও সংঘ ঘনিষ্ট ইমামদের কাছে, কখনও মাদ্রাসায় পাঠরত ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে জাতীয়তাবাদী মুসলিম হওয়ার পাঠ দিতে দেখা গেছে। এ রাজ্যেও সংখ্যালঘু মুসলিমদের আশ্বস্ত করতে বিজেপি ও সংঘ পরিবার একই নীতি নিয়ে এগোবে। রাজ্যে নিজেদের সাংগঠনিক অবস্থা মাথায় রেখেই, সংখ্যালঘু মোর্চার তরফে তাদের এই কর্মসূচিকে প্রচারের আনতে কোনও কার্পণ্য্য করছে না বিজেপি। যদিও, সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর মতে, নাগরিকত্ব নিয়ে সরব হয়ে সংখ্যালঘু মুসলিমের সমর্থন পাওয়ার আশা করা অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। তৃণমূলের নেতা তাপস রায় বলেন, মুর্শিদাবাদে গিয়ে বৈঠক করলেই জেলার সংখ্যালঘুরা বিজেপিকে সাদরে বরণ করে নেবে না। আসলে, কেন্দ্রের টাকায় মোচ্ছব হবে তিন দিন ধরে, কাজের কাজ কিছু হবে না।