কোনও বাইরের দেশের সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের নিজেদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে অনেক কিছু ঘুরিয়ে দেখানো বা দেশের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চল কূটনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই আছে। এই ধরনের সফরকে সাধারণত ‘ফেমিলিয়ারাইজেশন ট্রিপ’ বা পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সফর বলেই বর্ণনা করা হয়।
এটার উদ্দেশ্য থাকে আমন্ত্রণকারী দেশ সম্পর্কে অতিথিদের যদি কোনও ‘ভুল ধারণা’ থেকে থাকে তাহলে সেগুলো দূর করা এবং একটা ‘ট্র্যাক-টু’ চ্যানেলের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের সেতু গড়ে তোলা।
বাংলাদেশের সাংবাদিকরাও যুক্তরাষ্ট্র বা পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ কিংবা চীন-জাপান থেকে এই ধরনের আমন্ত্রণ বহুদিন ধরেই পেয়ে থাকেন এবং নিয়মিতই তারা সে সব দেশে সফরে যান।
তবে ঘরের পাশে দক্ষিণ এশিয়ার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত ও পাকিস্তান একই সময়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে এবং আলাদা আলাদাভাবে বাংলাদেশের দুটি প্রতিনিধিদল এই দুটি দেশে সফর করছে– এই জিনিস আগে কখনোই দেখা যায়নি। অথচ ঠিক এই বিরল ঘটনাই ঘটল গত সপ্তাহে।
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কূটনৈতিক সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দল গত সপ্তাহেই ঘুরে গেলেন দিল্লিতে। প্রায় জনাবিশেক সাংবাদিকের দলটি ভারতের রাজধানীতে থাকাকালীন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বা সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যেমন দেখা করেছেন, তেমনি দিল্লির শীর্ষস্থানীয় একাধিক স্ট্র্যাটেজিক থিংকট্যাংকের গবেষক ও ফেলোদের সঙ্গেও তাদের মতবিনিময় হয়েছে।
তবে ভারতে এই মুহূর্তে লোকসভা নির্বাচন চলছে বলে সহজবোধ্য কারণেই কোনও পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদের সঙ্গে তাদের দেখা হয়নি।
মজার ব্যাপার হলো, ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের আরও একটি প্রতিনিধিদল পাকিস্তান সফর করছিলেন। রাজধানী ইসলামাবাদে বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গেও তাদের সাক্ষাৎ হয়েছে, পাকিস্তানের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী আত্তাউল্লাহ তারার তাদের মধ্যাহ্নভোজেও আপ্যায়িত করেছেন।
বস্তুত বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ওই পাকিস্তান সফর ছিল সে দেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়েরই আমন্ত্রণে। তথ্যমন্ত্রী আত্তাউল্লাহ তারার নিজেও প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের দল পিএমএল (নওয়াজ)-এর শীর্ষস্থানীয় নেতা, তিনি এখন দলের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল পদে রয়েছেন।
এ কথা সুবিদিত যে পাকিস্তান সরকার অতীতের তিক্ততা ভুলে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য জোরালো চেষ্টা চালাচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে জেলবন্দি ইমরান খানের আমলেই এই তৎপরতা শুরু হয়েছিল, এখন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের আমলেও সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের পাকিস্তানে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছিল ঠিক সেই পটভূমিতেই।
দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক হালচাল নিয়ে ওয়াকিবহাল, দিল্লিতে এমন একজন বিশেষজ্ঞর কথায়, ‘ভারত বাংলাদেশের সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানালে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কও এখন চমৎকার, এবং এর আগেও ভারতে এরকম বহু সফর হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানও যেভাবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গেছে, সেটা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। দুটো সফরের টাইমিং মিলে যাওয়াটা অবশ্য আমি কাকতালীয়ই বলবো, কিন্তু এটা যে এই অঞ্চলে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বর প্রতিই দিকনির্দেশ করে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।’
বস্তুত অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশের অপরিসীম গুরুত্ব ভারত অনেক আগেই অনুধাবন করেছে, এখন পাকিস্তানও সেই একই ধারায় ভাবতে বাধ্য হচ্ছে বলে তিনি ব্যাখ্যা করছেন।
দিল্লিতে থাকাকালীন বাংলাদেশের সাংবাদিকরা মতবিনিময় করেছেন অন্তত দু’টি থিংকট্যাংকের সঙ্গে– একটি হলো ‘রিস’ বা আরআইএস (রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজ), আর অপরটি ওআরএফ (অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন)। এই দু’টি প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশ নিয়ে বিশদে গবেষণা করে থাকে, আর সেখানে মতবিনিময়েও বাংলাদেশের এই ক্রমশ বেশি গুরুত্ব অর্জনের বিষয়টি উঠে এসেছে।