ফের শূন্য সিপিএম

রাজনীতি এক অদ্ভুত খেলা। কে যে কখন কার পক্ষে, তা বোঝাই দায়। একদা পশ্চিমবঙ্গে প্রবল প্রতিপক্ষ বাম আর কংগ্রেস এখন এক শিবিরে। আবার সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপিকে ঠেকাতে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিপক্ষ তৃণমূলের সঙ্গেও ইন্ডিয়া শিবিরে সিপিএম। এর যথার্থ ফল এবার দেখা গেলো পশ্চিমবঙ্গের লোকসভার ভোটে। নিজেরা একটাও আসন না পেলেও বিজেপির ভোটে ভাগ বসানোর খেলায় তারা প্রবল প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসকে বেশ কয়েকটা আসন উপহার দিলো। এমনই মনে করছেন রাজনৈতিক মহলের একাংশ।

পশ্চিমবঙ্গে একুশের বিধানসভা ভোটের সময় থেকেই তরুণ প্রজন্মকে সামনে এনে নিজেদের রক্তক্ষরণকে ঠেকাতে চেয়েছিল সিপিএম। কিন্তু তা কাজে আসেনি। তবু চব্বিশের লোকসভা ভোটে দীপ্সিতা, সৃজন, সায়নদের মতো তরুণ প্রজন্মের মুখকে প্রার্থী করে আশায় ছিলেন আলিমুদ্দিনের কর্তারা। দৈনিক প্রচার তো বটেই, সোশ্যাল মিডিয়াতেও রীতিমতো ছাপ ফেলেছিলেন তারা। কিন্তু ভোট বাক্সে তার প্রভাব পড়েনি। গণনা শুরুর সময় থেকেই ভোট অঙ্কের মূল লড়াইয়ের ধারে কাছে দেখা গেলো না শ্রীরামপুর, তমলুক, যাদবপুর ও হাওড়ার সিপিএম প্রার্থীদের।

উল্টো এই যুব প্রার্থীরাসহ সিপিএমের দুই প্রবীণ প্রার্থী–রাজ্য সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিম আর সুজন চক্রবর্তী– বিজেপির ভোটে ভাগ বসিয়ে প্রবল বিরোধী তৃণমূল প্রার্থীকে জিতিয়ে দিলেন। ভোট গণনার শুরুর দিকে অবশ্য মুর্শিদাবাদে বেশ কয়েকবার এগিয়ে থেকে বামেদের মধ্যে ক্ষীণ আশা জুগিয়েছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সেলিম। তবে দিনের শেষে দ্বিতীয় স্থান পেয়ে মুখরক্ষা করার চেষ্টা করেছেন তিনি।

নির্বাচন কমিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, মুর্শিদাবাদ আসনে তৃণমূলের আবু তাহের খান পেয়েছেন ৬ লাখ ৮০ হাজার ৭৮৩, সিপিএমের সেলিম ৫ লাখ ১৭ হাজার ২৫৮ ও বিজেপির গৌরীশংকর ঘোষ ২ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৬। আসনটিতে সিপিএম ও বিজেপির ভোট যোগ করলে দাঁড়ায় ৮ লাখ ৮ হাজার ১৩৪।

অপরদিকে, যাদবপুরে লাল ঝান্ডা ওড়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন সৃজন ভট্টাচার্য। তৃণমূলের সায়নীর চেয়ে সৃজন পিছিয়ে রয়েছেন প্রায় চার লাখ ভোটে। দ্বিতীয় স্থানে বিজেপি। এখানেও একই অবস্থা। তৃণমূলের সায়নী ঘোষ ৭ লাখ ৮৩৪, বিজেপির অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৩৬১, সিপিএমের সৃজন ভট্টাচার্য ২ লাখ ৪৯ হাজার ১৫৮। এক্ষেত্রে মোট তৃণমূল-বিরোধী ভোট ৭ লাখ ৮ হাজার ৫১৯।

শ্রীরামপুরে সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের জেএনইউর নেত্রী দীপ্সিতা ধর ‘নো ভোট টু বিজেপি’ স্লোগান তুলে ভোট পেয়েছেন ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৯টি। তৃণমূল প্রার্থী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় পেলেন ৪ লাখ ৯১ হাজার ৩০১ আর বিজেপির কবীর শংকর বোস পেলেন ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৮৮৫। এক্ষেত্রে বিরোধী ভোট যোগ করলে দাঁড়ায় ৫ লাখ ২৭ হাজার ১৪৪।

সিপিএমের সাবেক সাংসদ সুজন চক্রবর্তী এবার যাদবপুর থেকে সরে গিয়ে দমদমে প্রার্থী হয়েছিলেন জয়ের আশায়। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি তারও। তৃতীয় স্থানে থামতে হয়েছে তাকে। এখানে তৃণমূলের সৌগত রায় ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৮৮৮, বিজেপির শীলভদ্র দত্ত ৪ লাখ ১ হাজার ৮৭৩ ও সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী ২ লাখ ৬ হাজার ৩২৯ ভোট পেয়েছেন। এখানেও বিরোধীদের মোট ৬ লাখ ৮ হাজার ২০২, যা তৃণমূল প্রার্থীর চেয়ে থেকে বেশি।

গত লোকসভা ভোটে বামেদের প্রায় ১৫ শতাংশ ভোট বিজেপিতে চলে গিয়েছিল। উনিশের লোকসভা ভোটে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল সাকুল্যে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। এর মধ্যে সিপিএম ও কংগ্রেস যথাক্রমে ৬ দশমিক ৩৪ এবং ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। শতকরা ১ শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছিল বাম শরিকদের ভোট। ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, সিপিআইয়ের শতকরা প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ, শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ।

প্রশ্ন উঠছে, সিপিএম এত দিন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি নিয়ে রাজ্যে বিরোধী মতকে নিজেদের দিকে টানতে পারলেন না, অথচ বিরোধী ভোটকে ভাগ করে তারা কার হাতকে শক্ত করলেন? বামেদের এই ভোটে ভাগ বসানোর খেলায় নিজেদের ভোট তো বাড়লোই না, উল্টো ভোট ভাগাভাগির কারণে বেশ কয়েকটি আসনে তৃণমূল ফায়দা পেয়ে গেলো। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে রক্তক্ষরণ আর বাড়িয়ে এবারও ‘লাস্ট বয়’ হয়ে থাকতে হলো বামেদের। এরপরও কি বামেদের পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী শক্তি হিসেবে বিশ্বাস করবেন সাধারণ মানুষ- এটিই এখন বড় প্রশ্ন, এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।