সৌদি আরব ও ইসরায়েলের গোপন সম্পর্কের নেপথ্যে

সৌদি আরব ও ইসরায়েলের প্রকাশ্য আঞ্চলিক সম্পর্ক আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হলেও মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী অবস্থানের প্রয়োজনেই দেশগুলোকে এক করে ফেলেছে। তাই বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের হুমকি মোকাবিলার কথা বলে গড়ে তোলা এ গোপন সম্পর্ক এ অঞ্চলে নতুন দৃষ্টান্ত। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা তাদের এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে এমন বিষয় তুলে ধরেছে।

Untitled-design-14

প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক দিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের মিত্রদের জোটবদ্ধ হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিয়ে আসছিল। তবে সম্প্রতি প্রথা ভেঙে ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরব সম্পর্ক রাখছে। ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে গুরুত্ব পাওয়া সৌদি আরব আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতেই এ কাজ করছে।

বিষয়টি নিয়ে সৌদি আরব নীরব থাকলেও ইসরায়েল তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ঘটনা গোপনের চেষ্টা করেনি। গত সপ্তাহে ইসরায়েলের যোগাযোগমন্ত্রী সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতিকে নিজ দেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এর দুই দিন পর দেশটির সেনাপ্রধান ইরানের ব্যাপারে গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সৌদি আরবকে সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক ওফার জালজবার্গের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তিত রাজনীতির কারণে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি-প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতেই হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য সৌদি আরব ও মার্কিন নেতারা এই প্রক্রিয়াকে প্রধান শর্ত হিসেবে মনে করছেন।

জালজবার্গ বলেন, ‘ইরানকে প্রতিহত করতে সৌদি-ইসরায়েল প্রকাশ্য জোট গঠনের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনা এগিয়ে নেওয়া।’

মার্কিন প্রেসিডেন্টের জামাতা ও মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে দেশটির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জারেড কুশনারের মাধ্যমে এই শান্তি আলোচনার অচলাবস্থা নিরসনে কাজ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এই প্রচেষ্টাকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘চূড়ান্ত চুক্তি’ হিসেবেও অভিহিত করেছেন।

প্রতিবেদনে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে সৌদি আরবের স্বার্থের বিষয়টি তুলে ধরেন তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কবি মিচেল। তিনি বলেন, ‘এখানে আরব আঞ্চলিক শিবির গড়ে তুলতে দেশগুলোর মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতা বাড়ানো সৌদি আবরের আগ্রহের মূল কারণ।’

মিচেল বলেন, ‘কাতার ছাড়া উপসাগরীয় দেশগুলোর পাশাপাশি মিসর ও জর্ডানের জন্য দু’টি কৌশলগত হুমকি হলো ইরান ও ইসলামি সন্ত্রাসবাদ। আর এখানে যুক্তরাষ্ট্র কিছু এলাকায় তৎপরতা কমিয়ে দেওয়ায় সিরিয়ায় রাশিয়া ও অন্যান্য স্থানে ইরান ও তার মিত্ররা জায়গা করে নিয়েছে।’

তাই, এখন সৌদি আরবের জন্য ইসরায়েলকে সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগী উল্লেখ করে মিচেল বলেন, তারা ভালোভাবেই বুঝেছে যে, এখনই ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়তে হবে।

কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ আরও বিষয় থাকার পরও ফিলিস্তিনি শান্তি-প্রক্রিয়ার দাবি করে যাওয়া সৌদি আরবের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে। তাই ফিলিস্তিনি ইস্যুর চেয়ে আঞ্চলিক শক্তি বাড়ানোতেই তারা এখন বেশি আগ্রহী।

জাতীয় নিরাপত্তা শিক্ষা ইনস্টিটিউটের গবেষক মিচেল আরও বলেন, জেরুজালেম ও হারাম আল শরিফের পরিবর্তে মক্কা ও মদিনা অধিকারে রাখার মাধ্যমে নিজেদের ধর্মীয় গুরুত্ব ইরানের চেয়ে বাড়িয়ে নিতে চায় সৌদি আরব। এতে একসময় চাপের মুখে ফিলিস্তিন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ঢুকতে বাধ্য হবে আর ইসরায়েলের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে প্রকাশ্য অবস্থান নিতে পারবে দেশটি। তিনি বলেন, এখন ইসরায়েলি নেতারা ফিলিস্তিনি শান্তি-প্রক্রিয়ায় কিছু পদক্ষেপ নিলেই সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসবে।  

সৌদির সঙ্গে সমঝোতায় ইসরায়েলের লক্ষ্য তুলে ধরে পশ্চিম তীরের রামাল্লার রাজনৈতিক বিশ্লেষক খলিল শাহীন বলেন, ‘ফিলিস্তিনি শান্তি-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেই এ অঞ্চলের হুমকির বিষয়টি পরিবর্তন হয়ে যাবে। তখন সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক আর বিতর্কিত থাকবে না। কিন্তু এটা বোঝা জরুরি যে, আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েল শুধু এই উদ্দেশ্যে সম্পর্ক গড়ছে না।’  তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের সেনাবাহিনী, পরমাণু অস্ত্র ও প্রাযুক্তিক দক্ষতা এ অঞ্চলের সবার থেকে উন্নত। এরপরও তারা আরব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী। এর মূল কারণ একটি আঞ্চলিক চুক্তির মাধ্যমে দেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।’

খলিল শাহীন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ক্ষমতা কমিয়ে তা ইসরায়েলের মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে। আর এই আরব দেশগুলো টিকে থাকার পাশাপাশি আরো শক্তিশালী আঞ্চলিক শক্তির অংশ হওয়ার আশায় ইসরায়েলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে চাচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব কারণেই মূলত সৌদি আরব ও ইসরায়েল সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী হচ্ছে। এখানে ইরান একটি অজুহাত মাত্র।

তবে গবেষক ওফার জালজবার্গ মনে করেন, সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার সময় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তিনি বলেন, নেতানিয়াহুকে এখন সৌদি যুবরাজের নেওয়া ইসরায়েলের সঙ্গে আঞ্চলিক জোট গড়ার উপযোগী অভ্যন্তরীণ সংস্কার ও এর প্রকৃত বাস্তবায়নের ওপরও নির্ভর করতে হবে।

তবে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মাহজুব জাওহিরি বলেন, ইসরায়েলের এ ধরনের সম্পর্কে যাওয়ার মূল কারণ হলো সৌদি আরবের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পাশাপাশি এই অঞ্চলের শক্তিগুলোকে পুঞ্জীভূত করা। ইরানের বিষয়টি একটি অজুহাত হিসেবে দেখানো হলেও শক্তিশালী জোট গড়া নিয়ে ইসরায়েল উদ্বিগ্ন নয়।

উপসাগরীয় শিক্ষা কার্যক্রম বিভাগের এই শিক্ষক বলেন, সৌদি-ইসরায়েল জোট বরং ইরানকে এ অঞ্চলের ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে ভাবমূর্তি গড়তে সহায়তা করবে। এতে ইরান নিজেকে এ অঞ্চলে ইসরায়েলকে প্রতিরোধ করার একমাত্র ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।