যে বাস্তবতায় ইসরায়েল-সৌদি আরব ‘গোপন জোট’

মধ্যপ্রাচ্যে ইরানে ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সব অভিপ্রায় ও উদ্দেশ্যে সৌদি আরব ও ইসরায়েল কার্যত একটি জোটের আকার নিয়েছে। উভয় দেশের সম্পর্ক স্পর্শকাতর হলেও জোটের উন্নতি হচ্ছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে উভয় দেশের সম্পর্কের ইঙ্গিত উঠে আসছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে যে বাস্তবতায় উভয় দেশের এই গোপন জোট গড়ে উঠেছে, তা তুলে ধরা হয়েছে। একইসঙ্গে জোটের সম্ভাব্য গতিপথেও আলোকপাত করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।

cover_11112017_landscape

গত সপ্তাহে ইসরায়েলের সেনাপ্রধান জেনারেল গাদি আইসেনকট এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘ইরানকে মোকাবিলায় সৌদি আরবের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানে প্রস্তুত ইসরায়েল।’ এর কয়েকদিন পর প্যারিসে এক সম্মেলনে বক্তব্যকালে সৌদি আরবের সাবেক আইনমন্ত্রী ড. মুহাম্মদ বিন আবদুল করিম ইসা, যিনি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানে ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলার সমালোচনা করেন। এটি ছিল আরব বিশ্বের কোনও দেশের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রথম সমালোচনা। আর ইসরায়েলে সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা জানান, লন্ডনে সিনিয়র সৌদি প্রিন্সদের সঙ্গে দু’টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সেনা কর্মকর্তার ভাষায়, সৌদি আরবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এখন ইসরায়েল তাদের শত্রু নয়।

এই ইঙ্গিতগুলো কোনও দুর্ঘটনা ছিল না। এসব বৈঠক ও মন্তব্য ইরানকে হুঁশিয়ারি জানানোর জন্য সতর্কতার সঙ্গে সমন্বিত ও পরিকল্পিত। কারণ সৌদি আরব দেশটির মধ্যে এই বিষয়ে ধীরে আগাতে চাচ্ছে। যদিও ইসরায়েল স্বভাবগত কারণেই সৌদিদের চেয়ে এই বিষয়ে প্রকাশ্যে বেশি কথা বলছে। এখন পর্যন্ত এই সম্পর্কের বাস্তবতা ও কৌশল সম্পর্কে জানা যায়নি। তবে তা বাস্তবে বিরাজ করছে ও বাড়ছে।

ইরানের হুমকি

জোট গঠনের পরিস্থিতির প্রধান কারণ এটা। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোটের অভিযানে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের শাসনামলের অবসান ঘটলে শিয়া ইরানকে মোকাবিলায় সুন্নি আরব দেশগুলোর কৌশলেরও পতন হয়। সাদ্দামে পতনে ইরাকে শিয়া সমর্থিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব মাথা তুলে দাঁড়ায়, যা তেহরানে ঘনিষ্ট। ফলে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের সরকারের সমর্থনে যে শিয়া মিলিশিয়ারা সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করতে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ইরানের সমর্থন, রাশিয়ার বিমান হামলা ও সরঞ্জাম পরিস্থিতি আসাদের পক্ষে নিয়ে আসে। এতে তেহরান থেকে ভূমধ্য সাগর পর্যন্ত ইরানের একটি করিডোরের সম্ভাব্যতা তৈরি হয়। যা অনেক সুন্নি রাষ্ট্রের মতে, আরব মধ্যপ্রাচ্যে পারসিয়ানদের অনুপ্রবেশ। এ কারণে ইরান ও আরবের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি; যা একইসঙ্গে কৌশলগত ও ধর্মীয়।

এই মুহূর্তে ইরান ও দেশটির সমর্থিত বিভিন্ন শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী, যেমন—লেবাননের হিজবুল্লাহ জয় পাচ্ছে। ফলে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যকার শক্তিশালী সম্পর্ক উভয় দেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।

উভয় দেশই মনে করে, ইরানকে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হতে দেওয়া উচিত নয়। ইরানের সঙ্গে ছয় পরাশক্তির পারমাণবিক চুক্তিতে অসন্তোষ ছিল উভয় দেশরই। এছাড়া উভয় দেশই এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরির জন্য প্রধান শক্তি হিসেবে লেবাননের হেজবুল্লাহকে দায়ী মনে করে।

সৌদি যুবরাজ সালমান ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী

ট্রাম্প প্রভাব

একই সময়ে আরও বড় ধরনের অনেক কিছু ঘটে চলেছে। এই জোটের পেছনে শুধু ইরানের শক্তি বৃদ্ধি কারণ নয়। আরও কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের শাসনামল। সিরিয়ায় যুদ্ধে পরাজয় ও আরব বসন্তের ঝড়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা খর্ব হওয়া।

আপাত দৃষ্টিতে ওয়াশিংটনে নতুন প্রশাসন নিয়ে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের কোনও অভিযোগ কথা নয়। ট্রাম্প উভয় দেশই সফর করেছেন এবং কৌশলগত সম্পর্কে জোর দিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি ইরানের পারমাণবিক চুক্তিরও বিরোধিতা করেছেন দৃঢ়ভাবে। তিনি উপসাগরীয় মিত্র দেশগুলোতে নতুন অস্ত্র চুক্তি করছেন।

কিন্তু সহমর্মিতা এক বিষয়, আর বাস্তব কৌশল অন্য বিষয়। যদিও ট্রাম্পের অনেক কথাই সৌদি আরব ও ইসরায়েলের পক্ষে। তবে উভয় দেশই জানে যে, এই অঞ্চলে মার্কিননীতি ইতস্তত অবস্থায় রয়েছে।

সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়া ও ইরানের সামনে টিকতে পারেনি। এ পর্যন্ত শুধু মুখে কথা বললেও ইরানের প্রভাব খর্ব করতে দৃশ্যমান ও বিশ্বাসযোগ্য কোনও পদক্ষেপ নেয়নি।

ফলে সৌদি যুবরাজ নিজের স্বার্থে আরও সক্রিয় হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবাক হওয়ার কিছু নেই। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য খর্ব হওয়ার লক্ষ্মণ বুঝতে পেরে উভয় দেশই মধ্যপ্রাচ্যের এক সময় সক্রিয় রাশিয়ার দ্বারস্থ হচ্ছে।

ইসরায়েল আতঙ্ক

এই জোটের পেছনে আরেকটি মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। যুবরাজ সালমান ইরানকে মোকাবিলা ও নিজ রাজ্যকে নতুনভাবে গড়ে তোলা ও সংস্কারের দ্বৈতনীতি নিয়ে আগাচ্ছেন। আরব বসন্ত ও ইসলামি সহিংসতাসহ বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় সংস্কারে আগাচ্ছেন সালমান। যুবরাজ দৃঢ়ভাবে মনে করেন, টিকে থাকতে হলে এই অঞ্চলকে বদলাতে হবে। যা ইসরায়েলও চায়। তারাও মনে করে, যুবরাজের এমন সক্রিয়তার অনেক ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু তারা সিরিয়ায় যুদ্ধের সময় শুধু ভয়াবহতা দেখে গেছে। রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে সিরিয়াকে রক্ষা করছে রাশিয়া।

ইসরায়েল সিরিয়াকে একটি গবেষণাগার হিসেবে দেখছে। তারা মনে করে, সিরিয়ার ওপরই অঞ্চলটির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। ফলে তারাও সৌদি যুবরাজের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করেছে।

জোটের গন্তব্য

ইসরায়েল-সৌদি আরবের গোপন জোট কতদূর আগাতে পারবে, তা অনিশ্চিত। এক্ষেত্রে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তরের ওপর নির্ভর করবে এই জোটের গন্তব্য। এর মধ্যে রয়েছে সৌদি যুবরাজের সৌদি আরবে পরিবর্তন আনার প্রয়াস কি সফল হবে? তিনি সৌদি আরবের আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সামর্থ্যের বেশি সক্রিয়তা দেখাচ্ছেন?

মূলকথা হচ্ছে, সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ককে যদি আলোয় উদ্ভাসিত হতে হয় তাহলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে অগ্রগতি প্রয়োজন হবে। সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, তারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অর্থপূর্ণ শান্তি প্রক্রিয়া ছাড়া ইসরায়েল-সৌদি আরব জোট ছায়া হিসেবেই ঘুরপাক খাবে।